একটি জাতির মেরুদন্ড বলা হয় শিক্ষাকে। আর উন্নত ও শিক্ষিত জাতি গঠনের ভিত রচিত হয় প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে। শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার ভিত নড়বড়ে হলে তাকে শিক্ষা গ্রহণের কোনো না কোনো স্তরে গিয়ে ঝরে পড়তে হয়। এতে শতভাগ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরির কাজ বিঘিœত হয়। দেশকে শতভাগ শিক্ষিত মানুষের দেশে পরিণত করতে সরকার নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে। বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক দেয়া হচ্ছে এবং দেশের দরিদ্রপ্রবণ অঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া রোধে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিড-ডে মিল সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে বলতে হবে সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় কিছুটা গলদ রয়ে গেছে। শিক্ষাবিদদের মতে, প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার শিকারে পরিণত হয় শিশুরাই। শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার ভিত মজবুত করতে হলে দেশে তিন-চার ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা থাকা উচিত নয়। সব শিশু একই শিক্ষা ব্যবস্থায় যাতে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করতে পারে, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে সবার আগে। শিশুদের কেউ বাংলা মাধ্যমে, কেউ ইংলিশ মিডিয়ামে, কেউ মাদ্রাসায়, কেউ কিন্ডারগার্টেনে আবার কেউ এনজিও স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ নিতেই পারে। তারা যেখানেই প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করুক না কেন, অন্তত প্রাথমিক শিক্ষার শেষ স্তর পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সব মাধ্যমেরই শিক্ষা কারিকুলাম এক হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। একেক মাধ্যমের পাঠ্যসূচি একেক রকম। একই দেশের শিশু কোনো মাধ্যমে কোনো শ্রেণিতে হয়ত ৩টি বই পড়ছে, আবার আরেক মাধ্যমের শিশুকে সেই একই শ্রেণিতে ৭টি বই পড়তে হচ্ছে। দেশের প্রাথমিক শিক্ষার আরেকটি বড় সমস্যা হলো প্রথম শ্রেণিতে পড়া মাত্র ৬ বছর বয়সের একটি শিশুকে একসঙ্গে ৩টি ভাষা যথা বাংলা, ইংরেজি ও আরবি ভাষা শিখতে হয়। তাকে অ আ ক খ যেমন পড়তে ও লিখতে হয়, তেমনি এ বি সি ডি ও আলিফ বা তা ছা-ও শিখতে হয়। একসঙ্গে ৩টি ভাষা শিশুর ওপর চাপিয়ে দেয়ার ফলে সে আসলে কোনোটিই ভালোভাবে রপ্ত করতে পারে না। তার বাংলা ভাষার গাঁথুনি হয় দুর্বল, ইংরেজি ভাষা নিয়ে তৈরি হয় আতঙ্ক, আরবি ভাষা হয়ে পড়ে মুখস্থনির্ভর। এখন আবার প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করার কাজ চলছে। এর অর্থ হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিশুর পাঠদান করবে; যা একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এসএসসি পাস একজন শিক্ষক অষ্টম শ্রেণিতে কিভাবে পাঠদান করবেন? আর চাকরি রক্ষার্থে যদি পাঠদান করেনও তাহলে সেই শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষার্থী কী আশা করতে পারে? তাই আমাদের পরামর্শ হলো দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে এক ও অভিন্ন কারিকুলামের আওতায় আনতে হবে। প্রথম শ্রেণিতে শিশুকে শুধু বাংলা ও অঙ্কের সঙ্গে পরিচয় করাতে হবে। তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণিতে গিয়ে ইংরেজি বা আরবি ভাষা শেখাতে হবে। তাহলে শিশুর মধ্যে বিদেশি ভাষা শেখা নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হবে না। প্রাথমিক শিক্ষাকে পঞ্চম শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা ভালো; নতুবা প্রথমেই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াতে সক্ষম এ ধরনের শিক্ষক সারাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে নিয়োগ দিতে হবে। মোটকথা প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে বিচ্ছিন্নভাবে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে সুচিন্তিত উপায়ে যেকোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। আর তাহলেই দেশের প্রাথমিক শিক্ষার ভিত টেকসই ও মানসম্মত হবে।
Related Articles
বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরাম ও উন্নয়ন
আবদুল বায়েস বিখ্যাত ব্যক্তিদের একটি উক্তি দিয়ে নিবন্ধটি শুরু করা যেতে পারে। বাংলাদেশের উন্নয়ন হচ্ছে বিভিন্ন প্রতিকূলতাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়া। এই প্রতিকূলতার মধ্যে রয়েছে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অতি ঘন জনসংখ্যার ব্যবস্থাপনা এবং বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অনেকটা পৌরাণিক পাখির মতো, যে চিতাভস্ম থেকে বেঁচে ওঠে। বলাবাহুল্য, সেই সূত্রে তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে পুরোদস্তুর উন্নয়ন ধাঁধা হিসেবে […]
বাঙালির আত্মপরিচয়
অরুণ কুমার গোস্বামী : বাঙালির আত্মপরিচিতি একটি প্রবহমান প্রপঞ্চ। স্বাধীন বাংলাদেশের মূল প্রেরণা হচ্ছে ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি।’ তবে, বর্তমানের প্রেক্ষাপটে খাপছাড়া শোনা গেলেও এটি সত্য যে এক সময় বাঙালি বলতে এরকম সব ধর্মাবলম্বী বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হতো না। একটা সময় ছিল যখন ‘বাঙালি’ ও ‘মুসলমান’ আলাদাভাবে বোঝানো […]
ক্ষুদ্র ঋণে আত্মকর্মসংস্থান : অসম্ভব সাধারণীকরণ
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান : ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরির প্রসঙ্গটি নিয়ে আমাদের দেশে বহু বছর ধরেই কাজ হচ্ছে। সরকারি, বেসরকারি এমনকি ব্যক্তি পর্যায়েও বিষয়টি নিয়ে কাজ হচ্ছে। এটাকে আজকাল আবার কেউ কেউ স্ব-উদ্যোগ বলেও অভিহিত করেন। তবে যে নামেই ডাকা হোক না কেন মূল লক্ষ্য একটিই। আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। নিজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিজে করাকেই আত্মকর্মসংস্থান বলে। […]