আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয় তৎপরতায় নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হলো বিশ্ব ইজতেমা

 নিজস্ব প্রতিবেদক

দুনিয়া ও আখেরাতের শান্তি লাভের আশায় মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে অশ্রুসিক্ত নয়নে দুই হাত তুলে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের ‘আমিন, আল্লাহুমা আমিন, সুম্মা আমিন’ ধ্বনিতে মুখরিত আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে ৫৪তম বিশ্ব ইজতেমা গত ১৯ ফেব্রুয়ারি শেষ হয়েছে। মোনাজাতে লাখ লাখ মুসল্লি নিজের কৃতকর্মের জন্য মহান আল্লাহতায়ালার কাছে মা প্রার্থনা করে কেঁদে বুক ভাসান। মোনাজাতে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, শান্তি, সমৃদ্ধি, অগ্রগতি, ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তি এবং দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার তৌফিক কামনা করা হয়।


সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও উদ্যোগে দুই পর্বে বিভক্ত এবারের বিশ্ব ইজতেমা শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্পন্ন হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি সকালে দেওবন্দিদের পরিচালনায় আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় ইজতেমার প্রথম পর্ব। ১৭ ফেব্রুয়ারি বাদ ফজর মাওলানা সাদপন্থিদের পরিচালনায় শুরু হয় ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। ১৯ ফেব্রুয়ারি তাদের পরিচালনায় আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে ৪ দিনব্যাপী ৫৪তম বিশ্ব ইজতেমা।

ইজতেমা স্থানে যেন কোনো রকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে না পারে সে জন্য সরকারের পুলিশ-র‌্যাব-গোয়ন্দাবাহিনীর তৎপরতা ছিল লণীয়। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও শর্টসার্কিটঘটিত দু-একটি ছোটখাটো ঘটনা ছাড়া এবারকার বিশ্ব ইজতেমার পরিবেশ ছিল বেশ শান্তিপূর্ণ।

উল্লেখ্য, একসঙ্গে বিশ্ব ইজতেমা করা নিয়ে কিছুদিন ধরে সাদপন্থি ও দেওবন্দিদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। শেষ পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মধ্যস্থতায় উভয়প শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে একত্রে ইজতেমার আয়োজনে সম্মত হয়।

এবারের বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্যায়ে বিশ্ব তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বি দিল্লির হজরত মাওলানা সা’দ আহমেদের অনুসারীদের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত ইজতেমায় আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন দিল্লির মাওলানা শামীম। প্রায় ১৭ মিনিট স্থায়ী এ মোনাজাত বেলা ১১টা ৪৫ মিনিট থেকে শুরু হয় এবং তা চলে দুপুর ১২টা ২ মিনিট পর্যন্ত। তাৎপর্যপূর্ণ এই আখেরি মোনাজাতে জীবনের সব পাপ-তাপ থেকে মুক্তি, আত্মশুদ্ধি ও নিজ নিজ গুনাহ মাফের জন্য মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে রহমত প্রার্থনা করা হয়। এ সময় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে ফরিয়াদ জানান লাখ লাখ মুসল্লি। আল্লাহর দরবারে আকুতি মিনতি করে চোখের পানিতে বুক ভাসান ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা। আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন ধ্বনিতে মধ্যাহ্নের আকাশ-বাতাস মুখরিত করে মহান ও দয়াময় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি লাভের আশায় লাখ লাখ মুসল্লি আকুতি জানান।

আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে সূর্য উদয়ের পূর্ব থেকেই শুরু হয় ইজতেমামুখী ধনী-দরিদ্র, যুবক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষের ঢল। যানবাহন চলাচলে বিধিনিষেধ থাকায় গাড়ি না পেয়ে পায়ে হেঁটে মুসল্লিরা ধাবিত হয় ইজতেমা ময়দানে। আখেরি মোনাজাতের আগেই ইজতেমা ময়দান কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। অসংখ্য মুসল্লি ইজতেমা এলাকার বিভিন্ন সড়ক, অলি-গলি, মিল কারখানা ও বাসা-বাড়ির ছাদে এবং নৌকাসহ বিভিন্ন যানবাহনে বসে মোনাজাতে অংশ নেন। অনেকেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মোনাজাতে শরিক হন। এতে পুরো এলাকায় এক ধর্মীয় আবহ বিরাজ করছিল।

মাওলানা সা’দপন্থিদের আয়োজনে টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে আগামী বছরের (২০২০ সালের) ৩, ৪ ও ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে বিশ্ব ইজতেমা। বিশ্ব ইজতেমার মূল নজমের জামাতের সদস্য মো. হারুন-অর-রশিদ প্রাথমিকভাবে সম্ভাব্য ওই তারিখ নির্ধারণ করেছেন। এছাড়াও চলতি বছরের ২২ হতে ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত ৫ দিনব্যাপী মাওলানা সা’দ অনুসারীদের জোড় ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে।

১৬ ফেব্র“য়ারি প্রথম দফা আখেরি মোনাজাতের পর জোবায়ের অনুসারীরা ২০২০ সালের ইজতেমার তারিখ ঘোষণা করেন। সে অনুযায়ী মাওলানা জোবায়ের অনুসারীদের আগামী বিশ্ব ইজতেমার প্রথম দফা ২০২০ সালের ১০, ১১ ও ১২ জানুয়ারি এবং ২য় দফা ১৭, ১৮ ও ১৯ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে। আর তাদের ৫ দিনের জোড় ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে ২০১৯ সালের ২৯ ও ৩০ নভেম্বর এবং ১, ২ ও ৩ ডিসেম্বর।

এদিকে ১৮ ফেব্রুয়ারি আখেরি মোনাজাতের পূর্বে ইজতেমা ময়দানের মিডিয়া সেন্টারে স্থানীয় সংসদ সদস্য যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল সাংবাদিকদের জানান, আগামী বিশ্ব ইজতেমা দু’পকে নিয়ে একসঙ্গে একটানা অনুষ্ঠানের চেষ্টা চালানো হবে। দু’প আন্তরিক হলে সবকিছুই সম্ভব।

দ্বিতীয় দফা ইজতেমায় ১৯ ফেব্র“য়ারি বাদ ফজর উর্দুতে বয়ান করেন দিল্লির হাফেজ ইকবাল নায়ার। তা বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা মুফতি ওসামা বিন ওয়াসিফ।

হেদায়তি বয়ানে মাওলানা শামীম মুসলিমদের উদ্দেশে বলেন, আল্লাহর জন্য দৈনিক ৪ ঘণ্টা সময় ব্যয় করতে হবে এবং মসজিদে কমপে ২০ জনকে দ্বীনের দাওয়াত দিতে হবে। পরামর্শ করে কাজ করলে তা সুন্দর ও সুষ্ঠু হয়। সকল কাজই পরামর্শ করে করার জন্য আহ্বান জানান তিনি।

তুরাগ তীরে অনুষ্ঠিত ৫৪তম বিশ্ব ইজতেমায় আখেরি মোনাজাতে শত শত মহিলাও অংশ নেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা শতশত মহিলা ইজতেমা ময়দানের আশপাশে, কল-কারখানা ও বাসা-বাড়ির ছাদসহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন।

মাওলানা সা’দপন্থি মাওলানা মো. আশরাফ আলী জানান, ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, কাতার, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও চীনসহ প্রায় ৩৬টি দেশের তবলীগ জামাতের সহস্রাধিক বিদেশি মেহমান এবারের বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণ করেন।

Post a Comment

0 Comments