নিজস্ব প্রতিবেদক
২০১৮ সালে মৃত্যুদ-ের বিধান রেখে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন পাস হয়। ওই বছরই সরকার মাদকের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করে। পাশাপাশি সরকারপ্রধানসহ রাষ্ট্রের শীর্ষ মহল থেকে মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনাও দেয়া হয়। ফলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাদকের বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে মাদক কারবারিরা এখন নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করছে। সড়ক, রেল ও নৌপথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির কারণে এবার আকাশপথকেও মাদক বহনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি ব্যাগে বহন করার পরিবর্তে মানবদেহের অভ্যন্তরে লুকিয়ে মাদক পাচারের প্রবণতা বাড়ছে। মিয়ানমার থেকে টেকনাফ দিয়ে সবচেয়ে বেশি ইয়াবা বাংলাদেশে ঢোকে বলে সেখানে অভিযান জোরদার করায় পাচারকারীরা রুট পাল্টিয়ে এখন সমুদ্রপথে সরাসরি চট্টগ্রাম নিয়ে আসছে ইয়াবা। চট্টগ্রাম থেকে আকাশপথে সে ইয়াবা চলে আসছে ঢাকায়। তাছাড়া মিয়ানমার থেকে টেকনাফের পরিবর্তে সমুদ্রপথে ইয়াবা চলে যাচ্ছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে। সেখান থেকে স্থল সীমান্ত পথে ইয়াবা ঢুকছে বাংলাদেশে।
বিমানবন্দরে নিরাপত্তায় নিয়োজিতরা জানিয়েছেন, বিমানবন্দরে ইয়াবা কারবারিদের ঠেকানো একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ তারা ইয়াবা বহন করছে পাকস্থলীর মাধ্যমে। সহজে এদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না। যাদের ধরা হয়েছে তাদের সিংহভাগই ধরা পড়েছে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে। আর সন্দেভাজনদের আটকের পর তাদের এক্সরে মেশিনে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হয়।
বিমানবন্দরে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, বিমানবন্দরে স্ক্যানার দিয়ে সহজেই ধরা পড়ে স্বর্ণ। কিন্তু মাদক ধরার ক্ষেত্রে স্ক্যানার কাজে আসছে না। কারণ ইয়াবা বা অন্য মাদক মেটালজাতীয় পদার্থ নয়। ইয়াবা ধরার ক্ষেত্রে এক্সরে কার্যকরী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমানবন্দরে দেহের ভেতরে বহন করা মাদক শনাক্তের প্রযুক্তি না থাকায় এ পথকে বেছে নিয়েছে মাদক চক্র। শুরুতে যাত্রীবেশে ব্যাগে লুকিয়ে আনলেও এখন শরীরের নানা অঙ্গে বা পেটের ভেতরেই মাদক বহন করছে পাচারকারিরা, যা স্ক্যানারে ধরা পড়ে না। কারণ, মাদক আসলে মেটাল না। মাদক ধরতে প্রয়োজন এক্সরে মেশিন, যেটি বিমানবন্দরে নেই। তবে কক্সবাজার বা চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে ধরা না পড়লেও শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আর্মড পুলিশের নিজস্ব গোয়েন্দা তথ্য কাজে লাগিয়ে অপরাধীকে শনাক্ত করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারা মাদকের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান দলমত নির্বিশেষে অব্যাহত রেখেছে। সড়ক, রেল, নৌপথ কিংবা আকাশ পথ Ñ যে মাধ্যমেই মাদক বহন করা হোক না কেন, জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে এবং হবে। কাউকেই কোনোরূপ ছাড় দেয়া হবে না।
জানা যায়, মাদক ব্যবসার নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে চট্টগ্রাম। ইয়াবার পাশাপাশি গাঁজা, ফেনসিডিলসহ প্রায় সব ধরনের মাদকই চট্টগ্রামে কমবেশি পাওয়া যায়। সম্প্রতি বেড়েছে দামি মাদক কোকেনের আমদানি। যদিও দেশে এর তেমন চাহিদা নেই। তা সত্ত্বেও গত ৩ মাসের ব্যবধানে কোকেনের বড় দুটি চালান ধরা পড়েছে চট্টগ্রামে; যার আনুমানিক মূল্য ২ কোটি টাকা। আটক হয়েছে দুই মাদক ব্যবসায়ী। গত ২৫ নভেম্বর নগরীর হালিশহর বড় পোল এলাকায় আনোয়ার নামে এক মাদক ব্যবসায়ী ১ কেজি কোকেনসহ র্যাবের হাতে আটক হয়। এছাড়া নগরীর টাইগারপাস থেকে ৮২০ গ্রাম কোকেনসহ বখতেয়ার হোসেন নামের মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করে র্যাব। বন্দরনগরীতে কোকেনের প্রথম বড় ধরনের চালানটি ধরা পড়ে ২০১৫ সালের জুন মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে। সূর্যমুখী তেলের ঘোষণা দিয়ে ল্যাটিন আমেরিকার দেশ বলিভিয়া থেকে আনা হয় ৩০০ কোটি টাকার তরল কোকেন। ১০৭টি ড্রামে ভরে ২০ টন তেল আনা হলেও একটি ড্রামে ছিল ১৮৫ কেজি তরল কোকেন। এ ঘটনায় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের খান জাহান আলী গ্রুপের চেয়ারম্যানসহ ৭ জনকে আসামি করে মামলা হয়।
জানা গেছে, দাম অত্যন্ত বেশি হওয়ায় বাংলাদেশে কোকেনের তেমন একটা চাহিদা নেই। মূলত ইউরোপ-আমেরিকাতেই মাদকাসক্তদের কাছে কোকেন জনপ্রিয়। বহু মূল্যবান এই মাদকটি উৎপন্ন হয় মূলত ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে। তবে সরাসরি ইউরোপ-আমেরিকায় প্রবেশ করানো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই বিভিন্ন দেশ ঘুরে কোকেনের চালান ইউরোপ-আমেরিকায় যায়।
বাংলাদেশে কোকেন আসে দুবাই হয়ে। এরপর ভারত হয়ে তা চলে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করে চোরাচালানকারবারিরা। তারপরও দেশের অভ্যন্তরে যেকোনো ধরনের মাদকের বহন বা ব্যবহারের বিরুদ্ধে সরকারের গৃহীত জিরো টলারেন্স নীতি অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে চলেছে।
0 মন্তব্যসমূহ