একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা নির্বাচনি আমেজে সরব সারাদেশ

 নিজস্ব প্রতিবেদক : দশম জাতীয় সংসদের পূর্ণ মেয়াদ শেষে এখন চলছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন। এরই মধ্যে সকল প্রস্তুতি ও আনুষ্ঠানিকতা শেষে গত ৮ নভেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা একাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন। আর এতেই নির্বাচনি আমেজে সরব হয়ে উঠেছে সারাদেশ। তফসিল ঘোষণার পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা ভোটের আমেজে আনন্দ মিছিল নিয়ে তাদের পার্টি অফিসে সমবেত হতে থাকেন। অনেক স্থানে নেতাকর্মীদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করতেও দেখা যায়।


যদিও দীর্ঘদিন যাবতই দেশের রাজনীতিতে নির্বাচনি হাওয়া বইছে। এর পক্ষে-বিপক্ষে সকল আলোচনাই ছিল নির্বাচনকেন্দ্রিক। উৎসুক জনতা পর্যবেক্ষণ করছিল এবং এখনও করছে রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদল হবে কি না। আর রাজনীতিবিদরা নানা কৌশল প্রয়োগ করছেন জনগণের মন জয় করার জন্যÑ এদের কেউ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকতে চান, কেউ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে চান; আবার কেউ কেউ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার হতে চান। এসব প্রচেষ্টার একমাত্র বৈধ ও গণতান্ত্রিক উপায় হচ্ছে নির্বাচন। আর ইসি ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী সেই কাক্সিক্ষত একাদশ জাতীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে আগামী ২৩ ডিসেম্বর।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২৩ দফা (৩) উপদফা (ক) অনুযায়ী ৮ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় জাতির উদ্দেশে দেয়া রেডিও-টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণের মাধ্যমে তফসিল ঘোষণা করেন। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ সময় ১৯ নভেম্বর। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই হবে ২২ নভেম্বর এবং প্রত্যাহারের শেষ সময় ২৯ নভেম্বর। নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভোটের আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শুরু হবে নির্বাচনি প্রতীক বরাদ্দের পর, অর্থাৎ ১ ডিসেম্বরের পর। যদিও অনানুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা অনেক আগ থেকেই শুরু হয়ে গেছে।

জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে সিইসি সব রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান এবং বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন এবং ভোটগ্রহণে সীমিত পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করা হবে বলে জানান। এ ছাড়া তিনি জানান, ২০১৭ সালে সংলাপের মাধ্যমে ৪০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, সুধীসমাজ, গণমাধ্যম প্রতিনিধি, পর্যবেক্ষক সংস্থা, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও নারী নেত্রীদের পরামর্শ এবং সুপারিশ বিচার-বিশ্লেষণের পর গ্রহণযোগ্য বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

এদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর এখন বলা যায়, নির্বাচন নিয়ে রাখঢাকের অবসান ঘটেছে। সব পথ এসে মিলে গেছে ভোটের মাঠে। ভোটের মাঠের রেফারি সিইসি ভোটের ঘণ্টা-হুইসেল আনুষ্ঠানিকভাবে বাজানোর পর রাজনীতিবিদদের আর অলস সময় পার করার সুযোগ নেই, এখন কেবলই ভোটের ব্যস্ততা। দলের শীর্ষ নেতা থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মী সবারই ভোটকেন্দ্রিক ব্যস্ততা বেড়ে গেছে বহুগুণ।

তবে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট, যার মধ্যে অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ তাদের সহযোগী ২০ দলীয় জোট সিইসি ঘোষিত বর্তমান নির্বাচনি তফসিলের বিরোধিতা করেছে। কারণ তারা তাদের সাথে আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে আরো পরে নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার পক্ষে দাবি জানিয়েছিল।

নির্বাচনি সমঝোতার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে গত ১ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ধারাবাহিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের (যার সাথে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট রয়েছে) সাথে দুইবার দীর্ঘ বৈঠক হয়েছে। দুইদিনের দীর্ঘ বৈঠকের পরও সুনির্দিষ্ট বিষয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাথে তাদের ঐকমত্য না হওয়ার কারণে তারা ওই আলোচনা অব্যাহত রেখে পরবর্তী সুবিধাজনক সময়ে নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা করতে সরকার ও ইসিকে অনুরোধ করেছিল। এ নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তথা বিএনপির মধ্যে চাপা ক্ষোভ থাকলেও তাদের দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঝে তফসিলের পর ভোটের আমেজ বইতে শুরু করেছে। তারাও অনানুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণাসহ ভোটের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।

ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মাঝে গত ৯ নভেম্বর থেকে দলের ধানমন্ডির দলীয় কার্যালয়ে মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করেছে। প্রথম দুই দিনে উৎসবের আমেজে আওয়ামী লীগের ৩ হাজার ২০০টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে।

তাছাড়া এএইচএম এরশাদের জাতীয় পার্টি, বিকল্পধারাসহ অন্যান্য দলের মনোনয়ন ফরমও বিতরণ শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলো তাদের মনোনয়নের বিষয়টি জোটনেত্রী শেখ হাসিনার ওপর ছেড়ে দিয়েছে। তারা জোটগতভাবে নৌকা প্রতীক নিয়েই নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়ার আশায় নিশ্চিন্তে দিন কাটাচ্ছে।

এদিকে মনোনয়ন ফরম বিতরণের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জোটভুক্ত হওয়া না হওয়ার প্রক্রিয়াও চলছে। ফলে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মানসিক চাপ দ্রুত বাড়ছে। দুয়ারে ভোট। হাতে সময় কম। নাওয়া-খাওয়ার সময় ঠিক থাকছে না। রাতের ঘুমও কমে এসেছে। এমন চাপের মুখোমুখি হওয়া সম্ভাব্য প্রার্থী ও মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মন-মেজাজের পাশাপাশি ভোটাররা আছে ফুরফুরে ও খোশ মেজাজে। বিশেষ করে নতুন ভোটারদের ভোট প্রদানের ক্ষণ গণনা শুরু হয়েছে। তাদের অপেক্ষা একটি সুন্দর সকালের; যেদিন জীবনে প্রথম তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে।

নির্বাচন কমিশনের হিসাবে একাদশ সাধারণ নির্বাচনে নতুন ভোটারের সংখ্যা দুই কোটির বেশি। পাঁচ বছর অন্তর ভোটাররা কয়েকটা দিন রাজা হয়েই থাকেন। তাদের দুয়ারে আনাগোনা বাড়ে প্রার্থীদের। এই ক’দিন বাক্সবন্দি হয়ে থাকবে প্রার্থীদের রাগ-অনুরাগ, চোখ রাঙানি।

ভোটের মাঠে ইতোমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে অর্থনীতির বাড়তি বলয়। নির্বাচনি এলাকার পথেপ্রান্তরে বেড়ে যাচ্ছে ভাসমান দোকান। বিশেষ করে চায়ের দোকান। ভাসমান চায়ের দোকানে এখন শুধু চা থাকে না, কফিও পাওয়া যায়। ৫ ও ১০ টাকার কফির স্ট্রিপ গরম পানিতে গুলিয়ে দিলেই হলো। এছাড়াও বিদ্যুতায়িত এলাকায় চায়ের দোকানে কফি মেকার বসেছে। বিস্কুট, কলা, বেকারি সামগ্রী ও হোটেলে বেচাকেনা বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে কয়েকটা দিন আলোঝলমলে হয়ে থাকবে গ্রামীণ অর্থনীতির আকাশ।

দেশের পথে প্রান্তরে পা বাড়ালে এখন নির্বাচনি প্রস্তুতির চিত্রই সর্বত্র দেখা যায়। এই সময়টায় আমন ধানের মাঠও সোনালি হয়ে উঠছে। কৃষক দিন গুনছে। আমন ধান ঘরে তোলার প্রস্তুতি নিয়েছে। কৃষকবধূ বাড়ির উঠান লেপে নিচ্ছে। উৎসবের এমন আয়োজনের পাশাপাশি নির্বাচনের উৎসবও গতি পাচ্ছে। চূড়ান্তভাবে দলীয় মনোনয়ন ঘোষিত না হওয়া পর্যন্ত এখন সকল সম্ভাব্য প্রার্থীই এমপি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে মাঠে যাচ্ছেন। কুশলাদি বিনিময়ের সঙ্গে এমন মধুর আচরণ করছেন যেন কতদিনের চেনা। বয়স্ক ভোটাররা তাদের এমন আচরণ দেখে অভ্যস্ত। বর্তমানে ভোটাররাও খুব কৌশলী। কখনও ডিপ্লোম্যাটের চেয়েও বেশি। এর কারণ ভিলেজপলিটিক্স দেখে ভোটাররা এতটাই অভ্যস্ত যে সম্ভাব্য প্রার্থীগণের কে বসন্তের কোকিল আর কে শহুরে বাবু তা ইতোমধ্যে বুঝতে শিখেছেন। এখন আর তারা ইমোশনাল নন। প্রার্থীগণের ইমোশনাল ব্ল্যাক মেলিং করার কথার অর্থ তারা বোঝে গ্রামীণ ভাষায়।

পাশাপাশি নতুন তরুণ ভোটার আছে প্রথম কলেজ লাইফের আমেজ নিয়ে। কোনো পরোয়া করছে না। তাদের একটাই লক্ষ্যÑ জীবনে প্রথমবারের মতো ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে।

এই তরুণ ভোটারদের নিয়েই ভাবতে হচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের। এর অন্যতম কারণ পুরাতন ভোটারের মনমেজাজ প্রার্থীদের জানা থাকলেও তরুণ নতুন ভোটারদের মনমেজাজ জোয়ার-ভাটার মতো। কখন কোন দিকে যায় তা তারা নিজেরাও ঠিক করতে পারে না। এদের আবেগও অনেক বেশি; অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন।

সব মিলিয়ে সারাদেশের সকল দলমতের প্রার্থী-সমর্থক ও ভোটারদের এখন কেবলই ভোটকেন্দ্রিক চিন্তা। এই নির্বাচনে প্রার্থীর মতো ভোটাররাও নায়ক। প্রার্থী ও ভোটার মিলেই নির্বাচনের এই পথটিকে গণতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাবে। এই পথ পাঁচ বছর অন্তর গণতন্ত্রের উৎসবের। যে উৎসবের পথ ধরে জনগণ কোনো একটি রাজনৈতিক দলকে বসিয়ে দেবে ক্ষমতায়।


শেষ কথা

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র বিতরণ শুরু হওয়ায় সারাদেশের চেয়ে নির্বাচনি আমেজ যেন রাজধানী ঢাকাতেই বেশি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় অফিস ঢাকা এখন প্রার্থী এবং তাদের সমর্থকদের পদচারণায় মুখর। সব মনোনয়ন প্রত্যাশীই মনোনয়নপত্র কিনতে নিজ সংসদীয় এলাকা থেকে নিয়ে এসেছেন হাজার হাজার সমর্থক। বলা যায়, প্রার্থীরা মনোনয়ন পাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন সমর্থকদের। ফলে এসব সমর্থকের পেছনে কাড়ি কাড়ি টাকাও খরচ করতে হচ্ছে প্রার্থীদের।

এবার সব সংসদীয় আসনেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মনোনয়ন প্রত্যাশী অনেক। ফলে সমর্থকদের হয়েছে পোয়া-বারো অবস্থা। একজন প্রার্থীর পক্ষে ঢাকায় এসে তারা অবলীলায় মিশে যাচ্ছেন আরেকজন প্রার্থীর সঙ্গে। প্রার্থীরাও হিসাবে রাখতে পারছেন কে তার সমর্থক, কে নয়। দেখা যাচ্ছে প্রার্থীরা যেসব সমর্থক নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন, তারা মিশে গেছেন অন্য প্রার্থীর শিবিরে। আবার অন্য প্রার্থীর সমর্থকরা এসে ভিড়েছেন আরেক প্রার্থীর সঙ্গে। প্রার্থীরা এসব মেনে নিচ্ছেন স্বাভাবিকভাবেই, নির্বাচনের অনুসঙ্গ হিসেবে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিটি সংসদীয় আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির একাধিক প্রার্থী থাকায় ভোটার-সমর্থকদের এখন সুদিন। তারা মনোনয়ন প্রত্যাশী সব প্রার্থীর কাছেই সমান মূল্যায়ন পাচ্ছেন। বাস্তবতা হলো একাধিক প্রার্থী হলেও সব প্রার্থী একই দলের হওয়ায় গ্রামবাংলা ছেয়ে গেছে নৌকা ও লাঙলের রঙিন পোস্টারে। নির্বাচন কমিশন অবশ্য এসব পোস্টার অপসারণ করতে বলেছে। কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচনি কালচারে নির্বাচন কমিশনের নিষেধাজ্ঞা অনেক সময় কাগজে-কলমেই থেকে যায়। প্রার্থী যেমন নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘন করেন, ভোটাররাও করেন।

তারপরও নির্বাচন হয়। প্রতিবারের মতো এবারও হবে। ২৩ ডিসেম্বরের নির্বাচনে এই সমর্থকরাই তাদের পছন্দের একজন প্রার্থীকে নির্বাচিত করবেন। সে অর্থে বলা যায়, ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ভোটাররাই হয়ে থাকবেন নায়ক-মহানায়ক।

Post a Comment

0 Comments