বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ফের রেকর্ড : অর্থনীতিতে স্বস্তির সুবাতাস

অর্থনীতির সূত্র ও আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। সেটা থাকলে সে দেশের আর্থিক সক্ষমতা ভালো বলে ধরে নেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকে এখন যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে তাতে প্রায় ৯ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। তবে শুধু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকেই আর্থিক সক্ষমতা হিসাবে না দেখার পরামর্শ আছে অর্থনীতিবিদদের কাছ থেকে।


বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, এপ্রিল শেষে রিজার্ভ আবার ৩৩ বিলিয়ন (৩ হাজার ৩১১ কোটি) ডলারের ঘর অতিক্রম করে। গত বছরের জুনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ৩৩ বিলিয়ন ডলার হয়। এরপর বেশ কয়েকবার ওঠানামা করে গত মাসে তা আবার ৩৩ বিলিয়ন ডলার হয়; যা আগের মাসের চেয়ে ৭০ কোটি ৯০ লাখ ডলার বেশি। বাংলাদেশকে দুই মাস পরপর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিল পরিশোধ করতে হয়। সাধারণত আকু বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ কমে যায়। এ কারণেই রিজার্ভের ওঠানামা হয়েছে।

গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে রিজার্ভ। রিজার্ভ ১০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে এলে ভাবমূর্তি নষ্ট হবে বলে ২০০১ সালে প্রথমবারের মতো আকুর আমদানি বিল বকেয়া রাখতে বাধ্য হয়েছিল বাংলাদেশ। ১৬ বছরের মাথায় সেই রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। এ হিসাবে গত ১৬ বছরে বাংলাদেশের রিজার্ভ বেড়েছে ৩২ গুণ।

রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়ে। অন্যদিকে আমদানি ব্যয় বাড়লে রিজার্ভ কমে। গত বছর থেকে সাম্প্রতিক সময়ে রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধির ধারা নিম্নমুখী। সম্প্রতি রেমিট্যান্স ইতিবাচক ধারায় ফিরছে। আগামী ঈদের আগে রেমিট্যান্স বাড়লে রিজার্ভের পরিমাণও আরো বেড়ে যাবে। এদিকে আমদানি ব্যয় আগের চেয়ে বাড়ায় দুশ্চিন্তাও বাড়ছে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে, গেল অর্থবছরে রেমিট্যান্স আয় প্রায় ১৪ শতাংশ কমেছে। গত অর্থবছরে প্রবাসীরা ১ হাজার ২৭৬ কোটি ৯৪ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন; যা গত পাঁচ অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। তবে সম্প্রতি ইতিবাচক ধারায় ফিরছে রেমিট্যান্স আয়ের প্রবৃদ্ধি। গত এপ্রিলে দেশের ১৩২ কোটি ৭১ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা; যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২১ শতাংশ বেশি। গত এপ্রিলে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থবছরের দশ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) মোট আয়ও বেড়েছে।

এ সময়ে রপ্তানি আয়ে কাক্সিক্ষত গতি আসেনি। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা গেছে, বাংলাদেশ জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে আয় করেছে ২ হাজার ৭৫৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ। গত অর্থবছরে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। গত দেড় দশকে এত কম প্রবৃদ্ধি হয়নি। অন্যদিকে গত অর্থবছরে (২০১৬-১৭) বাংলাদেশের মোট আমদানি ব্যয় হয়েছে ৪ হাজার ৮২১ কোটি ডলার। চলতি বছরের প্রথম ৩ মাসে আমদানি বাবদ খরচ হয়েছে ১ হাজার ১৬৫ কোটি ডলার। আর সে হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৩৮৮ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। এ হিসাবে জমা হওয়া রিজার্ভ দিয়ে প্রায় ৯ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।

এদিকে, রেমিট্যান্স প্রবাহের ইতিবাচক ধারায় সন্তোষ প্রকাশ করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, এবার অর্থবছর শেষে প্রবাসী আয় প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকবে। তিনি বলেন, প্রতিবারের মতো এবারও রমজান ও ঈদ সামনে রেখে প্রবাসীরা আরও বেশি রেমিট্যান্স দেশে পাঠাবেন। যার ফলশ্রুতিতে অর্থবছরের শেষ দুই মাস মে ও জুনে বেশি রেমিট্যান্স আসবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি রেমিট্যান্স সংক্রান্ত যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে মোট ১ হাজার ২০৮ কোটি ৮২ লাখ (১২.০৯ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। এই অঙ্ক গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিলের চেয়ে ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের এই ১০ মাসে প্রবাসীরা ১ হাজার ২৮ কোটি ৭২ লাখ (১০.২৮ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন।

সদ্য শেষ হওয়া এপ্রিল মাসে এসেছে ১৩২ কোটি ৭২ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স, যা গত বছরের এপ্রিলের চেয়ে ২১ দশমিক ৪৬ শতাংশ বেশি। মার্চ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৩০ কোটি ডলার। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি, স্থানীয় বাজারে ডলারের তেজিভাব এবং হুন্ডি ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপের কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহের এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিদেশে বাংলাদেশের জনশক্তির বড় অংশই আছে তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে। কয়েক বছর আগে জ্বালানি তেলের দর পড়ে যাওয়ার পর রেমিট্যান্স কমার পেছনে একে কারণ হিসেবে দেখাচ্ছিলেন অর্থনীতির বিশ্লেষকরা। বিশ্ব বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল এখন ব্যারেল প্রতি ৭০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। গত বছর এই সময়ে এর দর ছিল ৪০ ডলারের কিছু বেশি।

দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ প্রবাসী আয় আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। তেলের মূল্য হ্রাস এবং অভিবাসী কর্মীদের বিষয়ে দেশগুলোর বিভিন্ন নীতিমালা পরিবর্তনের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ আশানুরূপ ছিল না। পরিস্থিতির ধীরে ধীরে উত্তরণ ঘটছে। তেলের দাম বাড়ায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হয়েছে। প্রবাসীরা এখন বেশি আয় করছেন, যার ফলে বেশি অর্থ দেশে পাঠাতে পারছেন। গত অর্থবছরে (২০১৬-১৭) রেমিট্যান্স বেশ কমেছিল। অর্থনীতির অন্যতম প্রধান এই সূচক বাড়াতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার ইতিবাচক ফল এখন পাওয়া যাচ্ছে। আশা করা হচ্ছে এবার ১৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসবে।

বাংলাদেশের জিডিপিতে ১২ শতাংশ অবদান রাখে প্রবাসীদের পাঠানো এই বৈদেশিক মুদ্রা। দেশের রেমিট্যান্সের অর্ধেকের বেশি আসে মধ্যপ্রাচ্যের ৬ দেশÑ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, কুয়েত ও বাহরাইন থেকে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রেকর্ড ১ হাজার ৫৩১ কোটি ৬৯ লাখ (১৫.৩১ বিলিয়ন) ডলারের রেমিট্যান্স বাংলাদেশে আসে। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন এবার রেমিট্যান্স প্রবাহ ২০১৪-১৫ অর্থবছরকে ছাড়িয়ে যাবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ