নিজস্ব প্রতিবেদক
বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ প্রবৃদ্ধির ল্য কমিয়ে চলতি অর্থবছরের পুরো মেয়াদের জন্য সতর্ক মুদ্র্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন এ মুদ্রানীতিকে কর্মসংস্থানমুখী, প্রবৃদ্ধিসহায়ক ও সঙ্কুলানমুখী মুদ্রানীতি বলেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। তিনি বলেন, ভালো মানের ঋণের অভাবেই বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। যদি ভালো ঋণ বাড়ে তাহলে আমরা এ খাতের ঋণ প্রবাহের ল্য বাড়িয়ে দেব।
তবে অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ বলছেন, নতুন মুদ্র্রানীতির যেসব ল্যমাত্রা নেয়া হয়েছে, তা অর্জিত হবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মেলনকে গত ৩১ জুলাই ২০১৯-২০ অর্থবছরের মুদ্র্রানীতি ঘোষণা করেন গভর্নর ফজলে কবির। এতদিন বছরে দুটি মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক এখন থেকে পুরো অর্থবছরের জন্য একবারই মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে বলে জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। গত অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতিতে এই ল্য ছিল ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। গভর্নর ফজলে কবির বলেন, ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ল্য ধরা হলেও অর্জিত হয়েছে ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। তা থেকে বাড়িয়ে এবার ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আশা করা হচ্ছে।
গভর্নর বলেন, বাজেটে ঘোষিত মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশে পরিমিত রেখে ৮ দশমিক ২০ শতাংশ প্রকৃত জিডিপি অর্জনের জন্য পর্যাপ্ত ঋণ প্রসার সঙ্কুলানের ল্েয ২০১৯-২০ অর্থবছরে মুদ্রানীতির নীতিভঙ্গি আগেকার মতোই সতর্কভাবে সঙ্কুলানমুখী রয়েছে। নতুন মুদ্রানীতিতে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এর মধ্যে ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত ল্য ঠিক করেছে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ; যা গেল অর্থবছরের জুন পর্যন্ত ল্য ছিল ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের (জুলাই-জুন) পর্যন্ত সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির প্রপেণ করা হয়েছে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। আর অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয় ১৫ দশমিক ৯০ শতাংশ।’
২০১৮-১৯ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহের প্রপেণ ছিল সাড়ে ১৬ শতাংশ। কিন্তু গত জুন শেষে এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ। এটি গত অর্থবছরের ঘোষিত মুদ্রানীতির ল্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৫ শতাংশ কম।
ফেডারেল রিজার্ভ সুদহার কমানো হচ্ছে এবং ইইউএস-চায়না ও ব্রেক্সিট ইস্যুতে মুদ্রানীতিতে কোনো ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, ফেডারেল রিজার্ভ সুদহার কমাতে যাচ্ছে এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গুঞ্জন রয়েছে। আমাদের মুদ্রানীতিতে তার প্রভাব দেখতে আরও কিছু সময় লাগবে। তবে নেতিবাচক প্রভাবের চেয়ে ইতিবাচক প্রভাবই বেশি পড়তে পারে।
ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের যে ল্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা বাজেটের ঘোষিত ৮ দশমিক ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ল্যমাত্রা অর্জনে যথেষ্ট। চলতি অর্থবছরের জুনে বেসরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ কিন্তু প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। অর্থাৎ নিম্নতর জোগানের পরও ল্যমাত্রার চেয়ে উচ্চতর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। এই অর্জন দেশের ঋণবাজারের সঙ্গে মধ্য আয়ের দেশের ঋণবাজারের তুলনীয় পরিপক্কতা আসার শুভ সূচনার ইঙ্গিত দেয়।
তিনি বলেন, অতি উৎসাহী কিছু কিছু ব্যাংকের প্রশ্নযোগ্য মানের ঋণ সৃষ্টির প্রবণতা থেকে ঋণবাজারে আসা আকস্মিক তেজী প্রবণতা সংযত হওয়ায় বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি এখন দণি ও পূর্ব এশীয় অঞ্চলের দ্রুত প্রবৃদ্ধিশীল উদীয়মান বাজার অর্থনীতিগুলোর সঙ্গে তুলনীয় ধারায় এসেছে।
তার মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক গুণগত মানসম্পন্ন ঋণ বিতরণে গুরুত্ব দেয়ায় ব্যাপক হারে ঋণ বৃদ্ধি কমেছে কিন্তু প্রয়োজনীয় ঋণ বিতরণ হয়েছে।
গভর্নর আরও বলেন, উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের ল্েয নতুন বিনিয়োগ কর্মকা- জোরদার করার প্রয়োজন হবে। সে ল্েয ডলারের বিপরীতে টাকার প্রয়োজনীয় প্রতিযোগিতামূলক হার বজায় রাখার পদপে অব্যাহত থাকবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতির প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমলেও গত অর্থবছরের চেয়ে স্বস্তিকর অবস্থায় থাকবে।
ঋণের গড় সুদহার কমে আসারও দাবি করেন গভর্নর। তিনি বলেন, এটা আরও কমিয়ে আনতে খেলাপি ঋণ কমানো এবং নতুন খেলাপি ঋণ সৃষ্টি এড়ানোর ওপর মুদ্রানীতিতে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এজন্য গুণগত মানের ঋণ বিতরণের ওপর জোর দেয়া হয়েছে মুদ্রানীতিতে।
দেশে প্রবৃদ্ধি যে হারে হচ্ছে সে হারে বাংলাদেশে কর্মসংস্থান হচ্ছে না কেন – এমন প্রশ্নে গভর্নর বলেন, আমাদের প্রবৃদ্ধি সাপোর্ট করা মানেই কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। সব সেক্টরেই ল্য করেন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যেমন শিল্প মাধ্যমে আমাদের ৩৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে সুতরাং প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কর্মসংস্থান সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না কথাটা সত্য নয়।
এদিকে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং খাতে চাহিদা ও জোগান দুই েেত্রই সংকট চলছে। একদিকে ঋণ বিতরণ করার মতো অর্থ নেই; অন্যদিকে উচ্চ সুদের কারণে ঋণের চাহিদাও কম। তাই নতুন মুদ্র্রানীতির যেসব ল্যমাত্রা নেয়া হয়েছে, তা অর্জিত হবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ বলেন, মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ, যা অর্জিত ল্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ৩ শতাংশ বেশি। গত জুনে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ। ঋণ বাড়ছে না কারণ ব্যাংকগুলোতে অর্থ নেই। আমানত সংগ্রহ বাড়াতে পারছে না ব্যাংকগুলো। আমানত বৃদ্ধি করতে গিয়ে বেশি সুদ দিচ্ছে। অন্যদিকে স্প্রেড কমানো হচ্ছে না। ফলে ঋণের সুদহারও বেড়ে যাচ্ছে।
আজিজুল ইসলাম বলেন, বড় আরেকটি সংকট হলো, বিনিয়োগের বৃদ্ধি না হওয়া। শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি কমে গেছে। এর অর্থ বেসরকারি বিনিয়োগ ও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এদের ঋণের চাহিদাও কম। তাই বেসরকারি খাতে ঋণের যে ল্যমাত্রা ধরা হয়েছে, সেটিও অর্জিত হবে না। সব মিলিয়ে মুদ্রানীতির ল্যমাত্রাগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
0 মন্তব্যসমূহ