ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় ফণী: সরকারের সর্বোচ্চ সতর্কতার কারণে বাংলাদেশে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হয়েছে

 বিশেষ প্রতিবেদক : গত ৩ মে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় ফনীর তা-বে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যে। শত শত বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে, উপড়ে গেছে হাজার হাজার গাছ। বিদ্যুৎ ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপর্যয় নেমে এসেছে। ভুবেনশ্বর বিমানবন্দর ও পুরী রেলস্টেশন দুমড়েমুচড়ে গেছে। মারা গেছে অন্তত ৩৩ জন।


ভারতে আঘাত হানার ঠিক একদিন পর ৪ মে বাংলাদেশে ভয়ঙ্কর রূপে না এলেও বেশ আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় ফণী। তবে সরকারের আগাম সতর্কতা ও ব্যাপক প্রস্তুতিতে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। লন্ডন সফরে থাকাকালীনও খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখেন। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে সর্বোচ্চ তৎপর থাকার নির্দেশ দেন তিনি। বাংলাদেশে এই ঝড় প্রলয়ংকর রূপে না আসায় প্রধানমন্ত্রী আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করেন। ঝড়ের পর ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে দ্রুত ত্রাণসামগ্রী পৌঁছাতে এবং পুনর্বাসন করতে তিনি তাঁর দলের নেতাকর্মী ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন।

ফণী নিয়ে সরকারের প্রস্তুতির ঘাটতি ছিল না। উপকূলীয় এলাকাগুলোয় সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়। সারাদেশে নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিলের নির্দেশ দেয়া হয়। উপকূলীয় ১৯ জেলায় খোলা হয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় থাকা সব মানুষকে নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়ার নির্দেশ দেয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে ফায়ার সার্ভিস, নৌ, সেনা ও বিমান বাহিনীসহ ৫৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে প্রস্তুত রাখা হয়। প্রস্তুত রাখা হয় ৪ হাজার ৭১টি আশ্রয়কেন্দ্র। মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর এবং চট্টগ্রাম বন্দরকে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

পূর্বপ্রস্তুতি প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান জানান, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) ৫৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে প্রস্তুত রাখার পাশাপাশি উপকূলীয় সেনা ক্যাম্পগুলোকে সতর্ক করা হয়। ফণীর সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় ১৯ জেলায় সাড়ে ৩ হাজারের ওপরে আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়। জেলাগুলোতে ৫ লাখ করে টাকা, ২০০ টন চাল এবং ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার পাঠানো হয়। গঠন করা হয় স্বেচ্ছাসেবীদের বিশেষ দল ও মেডিকেল টিম। সবাইকে নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য উপকূলীয় এলাকাগুলোতে মাইকিং করেন স্বেচ্ছাসেবকরা। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ও একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলে। ছিল জরুরি টেলিফোন নম্বর।


চার দশকে সবচেয়ে শক্তিশালী ঝড়

ফণী ভয়ঙ্কর শক্তির বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তা-বলীলা দেখাতে পারে, জানিয়েছিলেন আবহাওয়াবিদরা। তাদের কথাই সত্যি হলো; বিশেষ করে উৎপত্তিস্থলের কাছাকাছি ভারতের উড়িষ্যায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। ভারতে আঘাত হানার পর কিছুটা দুর্বল হয়ে বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসে। বাংলাদেশ সরকার, প্রশাসন ও জনগণের পূর্বসতর্কতার কারণে এখানে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অনেক কমে এসেছে।

উল্লেখ্য, ১৯৭৬ সালের পর এতো শক্তিশালী ঝড়ের মুখোমুখি হয়নি এই অঞ্চল। গত ৪৩ বছরে অর্থাৎ ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে যতগুলো ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়েছে তার কোনোটি এতো শক্তিশালী আকার ধারণ করেনি। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের ঝড় বৈশ্বিক উষ্ণতা পরিবর্তনের ফল। বঙ্গোপসাগরের বায়ুম-লের পরিবর্তনের কারণে এমন প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতার সঙ্গে এখন এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি রাখতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, ১৯৬৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগরে মোট ৪৬টি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়, যার মধ্যে ২৮টি ঝড়ের সৃষ্টি হয়েছিল অক্টোবর-নভেম্বর মাসে। ৭টি মে মাসে এবং ১৯৬৬ ও ১৯৭৬ সালে মাত্র ২টি ঝড় সৃষ্টি হয় এপ্রিল মাসে। তবে ফণী আসে ভয়ানক এক আতঙ্ক হয়ে।


ফণী দুর্গতদের ত্রাণ পাঠানোর

নির্দেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার

ফণীর বিপদ কেটে যাওয়া এবং জানমালের তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হওয়ায় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে শুকরিয়া আদায় করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। লন্ডন সফরে থেকেও প্রধানমন্ত্রী ঘূর্ণিঝড়ের পরিস্থিতির সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখেন এবং ঝড় মোকাবিলায় সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন। ঝড়-পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের দুর্গত এলাকায় দ্রুত ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দেন। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত জনগণকে সহযোগিতা ও দ্রুত ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ সম্পন্ন করতে বলেন।

প্রধানমন্ত্রী ঘূর্ণিঝড়ের কারণে যারা নিহত হয়েছেন তাদের রূহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। তিনি শুধু প্রশাসন নয়, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরও দুর্গতদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানান।

জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট এলাকার উপজেলা ও জেলা প্রশাসন, সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, জনপ্রতিনিধি এবং বেসরকারি সংস্থা ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে সরজমিনে কাজ করছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর সদস্যরাও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পৌঁছেছেন। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে সহায়তা করার জন্য বিমান বাহিনীর সদস্যরা হেলিকপ্টার নিয়ে উপকূলীয় এলাকায় জরিপ কাজ পরিচালনা করছেন।


ফণী নামকরণ করেছে বাংলাদেশ

মানুষের মুখে মুখে এখন ফণী। ঘূর্ণিঝড়ের নাম ফণী কেন Ñ জনমনে রয়েছে নানা কৌতূহল। কিভাবে এলো এ নাম?

জানা গেছে, ফণী নামটি দিয়েছে বাংলাদেশ। ফণী অর্থ সাপ বা ফণা তুলতে পারে এমন প্রাণী। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, সাধারণত ঘূর্ণিঝড়ের আকার হয় অনেকটা সাপের ফণার মতো, যখন-তখন ছোবল মারে। সেই চিন্তা থেকেই ফণী নামকরণ করা হয়েছে।

উত্তর ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে যে ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়, তার নামকরণ করে মূলত ৮টি দেশ। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার আঞ্চলিক কমিটি একেকটি ঝড়ের নামকরণ করে। সেই নিয়মে এবারের নামকরণ করেছে বাংলাদেশ। ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ওমান, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, মালদ্বীপ Ñ এই দেশগুলো ঝড়ের নামকরণ করে থাকে এ অঞ্চলে। প্রতিটি দেশ ৮টি করে নাম তালিকাভুক্ত করে। মোট ৬৪টি নাম অন্তর্ভুক্ত হয়, সেখান থেকে একটি নাম বাছাই করা হয়। প্রতিটি দেশ একবার করে ঝড়ের নাম দিতে পারবে। বাংলাদেশের ওপর এবার সেই ভার ছিল। এরপরের ঝড়ের নাম হবে ভারতের প্রস্তাব অনুযায়ী ‘ভায়ু’। তারপরে আরও ৬টি ঝড়ের জন্য এখনও নাম তালিকায় রয়েছে। সেগুলো হলো হিক্কা, কয়ার, মাহা, বুলবুল, পাউয়ান এবং আম্ফান।


ভয়াবহ ঝড়গুলো

বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে ফণীর আগে বেশ কয়েকটি শক্তিশালী ঝড় আঘাত হেনেছে, চালিয়েছে তা-বলীলা। ১৯৭০ সালের গোর্কি ও ১৯৯১ সালের ম্যারিএন ঝড় এর অন্যতম। এই দুটি ঝড়ে বহু প্রাণহানি ঘটে।


গোর্কি

১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) দক্ষিণাঞ্চলে গোর্কি আঘাত হানে। ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে গোর্কির ভয়াবহতা ছিল সবচেয়ে বেশি। প্রায় ৫ লাখ মানুষ প্রাণ হারান। অসংখ্য বাড়িঘর মিশে যায় মাটির সঙ্গে। বেশিরভাগই জলোচ্ছ্বাসে ডুবে মারা যান। সিম্পসন স্কেলে ওই ঝড়ের মাত্রা ছিল ‘ক্যাটাগরি ৩’। ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২২২ কিলোমিটার এবং জলোচ্ছ্বাসের সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল প্রায় ৩০ ফুট। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তজুমদ্দিন উপজেলা। সেখানে ১ লাখ ৬৭ হাজার অধিবাসীর মধ্যে প্রায় ৭৭ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। ঝড়ে সম্পদ ও ফসলের ক্ষতি ছিল অকল্পনীয়। মারা যায় ১০ লাখের বেশি গবাদিপশু।


১৯৮৮ সালের ঘূর্ণিঝড়

১৯৮৮ সালের ২৯ নভেম্বর আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়টি ছিল ইতিহাসের অন্যতম বিধ্বংসী। এর ফলে দেশে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বড় বন্যা হিসেবে পরিচিত। ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ের ফলে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ৫ হাজার ৭০৮ জন মানুষ প্রাণ হারান। উপকূলীয় এলাকায় অবকাঠামোগত পর্যায়েও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বাংলাদেশের প্রায় ৭০ ভাগ ফসল নষ্ট হয়ে যায়, পরিমাণ ছিল প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার টন। ঝড়ে ৬৫ হাজার গবাদিপশু মারা যায়। ১৫ হাজার হরিণ ও ৯টি বাঘের মৃত্যু হয়। হিসাবে দেখা যায়, সেই সময় ৯৪১ কোটি টাকা সমমূল্যের ফসল নষ্ট হয়েছে।


ম্যারিএন

হতাহতের সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতি বিচারে এ ঘূর্ণিঝড়টি ছিল অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। সিম্পসন স্কেলে ঝড়ের মাত্রা ছিল ‘ক্যাটাগরি-৫’। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার বেগে এই ঝড় আঘাত হানলে প্রায় ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়। প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ প্রাণ হারান, ১ কোটি মানুষ হারান সহায়-সম্পদ সর্বস্ব। সন্দ্বীপ, মহেশখালী, হাতিয়াসহ দ্বীপগুলোতে বেশি প্রাণহানি ঘটে, যাদের অধিকাংশই ছিল শিশু ও বৃদ্ধ। তখন অনেক সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হলেও অসচেতনতা, ব্যাপক প্রচারের অভাব এবং অজ্ঞতার কারণে অনেকে সেখানে আশ্রয় নেননি। প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয় বলে তখন বিভিন্ন হিসাবে উঠে এসেছে। এমনকি বন্দরে নোঙর করা বিভিন্ন জাহাজ, লঞ্চ, জলযান নিখোঁজ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় ১০ লাখ ঘড়বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।


সিডর

মানুষের মুখে মুখে এখনও ফেরে ভয়ঙ্কর ঘুর্ণিঝড় সিডরের কথা। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে ২৬০ কিলোমিটার বেগের বাতাস নিয়ে হাজির হয় এ ঝড়। সঙ্গে ছিল ১০ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস। শ্রীলঙ্কান শব্দ সিডর, যার অর্থ ‘চোখ’। সিম্পসন স্কেলে ঝড়ের মাত্রা ছিল ‘ক্যাটাগরি-৫’। সরকারি তথ্যানুযায়ী, ২ হাজার ২১৭ জন প্রাণ হারান। পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বর নদের বেড়িবাঁধ ভেঙে ভেসে যায় ৬৮ হাজার ৩৭৯টি ঘরবাড়ি। বিনষ্ট হয়ে যায় ৩৭ হাজার ৬৪ একর জমির ফসল। সিডর দুর্গত মানুষ এখনও ওই ঝড়ের কথা ভুলতে পারেন না।


আইলা

আইলা আরেকটি ঝড়, যার ভয়াবহতা ছিল অকল্পনীয়। ২০০৯ সালে ২৫ মে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাংশে আঘাত হানে আইলা। মালদ্বীপের আবহাওয়াবিদরা এর নামকরণ করেন, যার অর্থ হলো ডলফিন বা শুশুকজাতীয় জলচর প্রাণী। ঝড়টির ব্যাস ছিল প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। ঘূর্ণিঝড় সিডর থেকেও যা ৫০ কিলোমিটার বেশি। আইলা প্রায় ১০ ঘণ্টা সময় নিয়ে উপকূল অতিক্রম করে। ১৯৩ জনের মৃত্যু ও ৭ হাজার মানুষ আহত হয়। ২ লাখ গবাদিপশু মারা যায়। ১১ জেলায় প্রায় ৬ লাখ ঘরবাড়ি ও ৮ হাজার ৮০০ কিলোমিটার রাস্তা বিধ্বস্ত হয়। খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার ৭১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে প্রায় দেড় লাখ একর জমি লবণাক্ত পানিতে তলিয়ে যায়। ২টি জেলার প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার মানুষ স্থায়ীভাবে এবং প্রায় সাড়ে ৪ লাখ মানুষ অস্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যূত হয়ে পড়েন। নিঃস্ব হওয়া সেই মানুষগুলোর অনেকে এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি।


ফণীর আঘাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান

ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে দেশে মোট ৫৩৬ কোটি ৬১ লাখ ২০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ধানের। এই ক্ষতির পরিমাণ ২৫১ কোটি টাকা। তাছাড়া সড়কের ক্ষতি হয়েছে ১৬১ কোটি ৬৩ লাখ টাকার। গত ৯ মে বাংলাদেশ সচিবালয়ে ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ ও পুনর্বাসন পরিকল্পনা প্রণয়নে আয়োজিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা শেষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।

উপস্থিত সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শাহ কামাল জানান, ঘূর্ণিঝড়ে ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে ৭৮ কোটি ১৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। বাঁধের ক্ষতি হয়েছে ২৫১ কোটি টাকা। স্থানীয় সরকার বিভাগের ২৪১ কিলোমিটার রাস্তা মেরামতে খরচ হবে ১৬১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। তিনি আরও বলেন, ৩৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে সেখানে মাছের ক্ষতি হয়েছে ২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। বন ও পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে ৫ কোটি টাকা। কৃষি বিভাগের ক্ষতি হয়েছে ৩৮ কোটি টাকা।

জানা যায়, ফণীর তা-বে সারাদেশে ৬৩ জন আহত হয়েছেন এবং ঘূর্ণিঝড়ে বরগুনায় ২ জন এবং ভোলা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরে ১ জন করে মোট ৫ জন মারা গেছেন। তাছাড়া ২ হাজার ৩৬৩টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ এবং ১৮ হাজার ৬৭০টি ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৬৩ হাজার ৬৩ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন জেলায় ২১ দশমিক ৯৫ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন ২৪১ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ফণীর কারণে ৩৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া নেত্রকোনায় হাওড়ের যে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় তা মেরামত করেছে। লক্ষ্মীপুরে ৩৫টি বিদ্যালয় ঘূর্ণিঝড়ে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। যাচাই-বাছাই করে সেগুলো সংস্কারের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

উল্লেখ্য, ঘূর্ণিঝড় ফণী দুর্গত মানুষের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ১৪ হাজার ৫০ মেট্রিক টন চাল, ৩ কোটি ৬৩ লাখ টাকা, ৪১ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার, ৪ হাজার বান্ডেল ঢেউটিন এবং গৃহ নির্মাণের জন্য ১ কোটি ২০ লাখ টাকা মঞ্জুর করা হয়েছে।

Post a Comment

0 Comments