জাতীয় সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বাড়ছে!

 নিজস্ব প্রতিবেদক

নির্ঝঞ্ঝাট মানুষের রক্ষাকবচ বলা হয় সঞ্চয়পত্রকে। সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণকারীরাই এর প্রধান গ্রাহক। এছাড়া ক্ষুদ্র ব্যবসাকে যারা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেন, তারাও নিশ্চিত বিনিয়োগ হিসেবে সঞ্চয়পত্র কিনে থাকেন। সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর দেশের অনেক পরিবারের জীবনযাপন নির্ভর করে বিধায় সঞ্চয়পত্রের সুদ বাড়ানো-কমানোর দিকে অনেকেরই দৃষ্টি থাকে। বলা হয়, সঞ্চয়পত্রের সুদ বাড়ালে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ে আর কমালে সরকারের জনপ্রিয়তা কমে। চলতি বছরের শেষ দিকে জাতীয় নির্বাচন হতে পারে। এ সময়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমালে জন-অসন্তুষ্টি সৃষ্টি হতে পারে এজন্য সরকার সে পথে যাবে না বলেই আভাস পাওয়া গেছে। যদিও গত বছর সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হচ্ছে বলে সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে ঘোষণা এসেছিল।


চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) সঞ্চয়পত্র বিক্রি অনেক বেড়ে গেছে। এ সময়ে নিট বিনিয়োগ এসেছে ২৮ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা, যা পুরো অর্থবছরের জন্য সরকার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ৯৬ দশমিক ০৬ শতাংশ। অর্থবছরের পুরো সময়ের জন্য সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে সরকারের নিট ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আগে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর ঘোষণা থাকলেও নির্বাচনি বছরে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমাবে না সরকার। উল্টো সঞ্চয়কারীদের সুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়ে সঞ্চয়পত্র কেনার প্রক্রিয়া সহজ ও আধুনিকায়নের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। সারাদেশে সঞ্চয়পত্রের অফিসগুলোকে অটোমেশনের আওতায় আনা হচ্ছে। এতে করে গ্রাহকরা সঞ্চয়পত্র ক্রয়, নগদায়ন এবং মুনাফা তোলার কাজটি ঘরে বসেই অনলাইনে করতে পারেন।

সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, গত জানুয়ারিতে সঞ্চয়পত্রসহ সব ধরনের জাতীয় সঞ্চয় স্কিম থেকে ৫ হাজার ১৪০ কোটি টাকা নিট ঋণ এসেছে সরকারের কাছে, যা একক মাস হিসেবে চলতি অর্থবছরের সর্বোচ্চ নিট ঋণ। এর আগে সর্বোচ্চ নিট ঋণ হয়েছিল অর্থবছরের শুরুর মাস জুলাইয়ে। ওই মাসে পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। এর আগে গত ডিসেম্বর মাসে জাতীয় সঞ্চয় স্কিমগুলো থেকে নিট ঋণ হয়েছিল ২ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা। গত নভেম্বরে নিট ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা, অক্টোবরে ৪ হাজার ৬২০ কোটি টাকা, সেপ্টেম্বরে ৩ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা, আগস্টে ৩ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা এবং অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৫ হাজার ৫৩ কোটি টাকা নিট ঋণ হয়েছিল সরকারের।

প্রসঙ্গত, প্রতিদিনের সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ থেকে আগের বিক্রি করা সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যেটি অবশিষ্ট থাকে, সেটাকেই নিট বিক্রি বলে হিসাব করা হয়।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে নিট বিনিয়োগ ছিল ২৩ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা, যা ওই অর্থবছরের জন্য এ খাত থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার নির্ধারিত ঋণের লক্ষ্যমাত্রার ১১৯ দশমিক ৭০ শতাংশ। ওই অর্থবছরে সঞ্চয় স্কিমগুলো থেকে সরকারের নিট ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা।

এ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আলোচ্য ৭ মাসে সঞ্চয় স্কিমগুলোর মধ্যে বরাবরের মতো সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে পরিবার সঞ্চয়পত্র থেকে। এখানে গত ৭ মাসের নিট ঋণ ১০ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে ৩ মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, নিট ঋণ ৭ হাজার ৮১২ কোটি টাকা। পেনশনার সঞ্চয়পত্রে নিট ঋণ এসেছে ২ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। ৫ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রে নিট ঋণ এসেছে ২ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। তাছাড়া মেয়াদি হিসাবে জমাকৃত অর্থ রয়েছে ৪ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা। ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডে নিট ঋণ আছে ১ হাজার ১৮২ কোটি টাকা।

বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছরে ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে সরকারের ৩২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়ার কথা রয়েছে ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। দেশি-বিদেশি উভয় উৎস থেকেই ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটায় সরকার। অভ্যন্তরীণ উৎসর মধ্যে আগে বেশি ঋণ আসত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে। সাম্প্রতিককালে বেশি ঋণ আসছে ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে। ব্যাংকবহির্ভূত খাতের প্রধান উৎস সঞ্চয়পত্র। এছাড়া ট্রেজারি বিল ও বন্ডের বিপরীতেও ঋণ নেয়া হয়।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বর্তমানে পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। ৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ, ৩ মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ, পেনশনার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ২০১৫ সালের ২৩ মে’র পর থেকে এ হার কার্যকর আছে। এর আগে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ছিল ১৩ শতাংশেরও বেশি। উল্লেখ্য, এখন সঞ্চয়পত্র ভাঙানো ও মুনাফা সংগ্রহ করা অনেক সহজ হয়ে গেছে। সঞ্চয়পত্রের টাকার জন্য বই জমা দিয়ে টোকেন নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না। মাস শেষে মুনাফার টাকা ও মেয়াদ শেষে আসল টাকা সরাসরি গ্রাহকের ব্যাংক একাউন্টে জমা হয়। আর টাকা জমা হওয়ার সঙ্গে গ্রাহকের মোবাইল শর্ট মেসেজ সার্ভিস (এসএমএস) ও ইমেইল করে জানিয়ে দেয়া হয়। সময়, অর্থের সাশ্রয় ও ভোগান্তি দূর করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ইএফটি (ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার) নামে গত বছর একটি সফটওয়্যার চালু করে। এ সফটওয়ারের মাধ্যমেই গ্রাহকরা এ সুবিধা পাচ্ছেন।

এখন এই সুবিধা আরো বাড়ানোর দিকে নজর দিয়েছে সরকার। তবে জানা গেছে, সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সায় না থাকলেও সরকারের ঊর্ধ্বতনদের অনেকেরই সঞ্চয়পত্রের সুদ বাড়ানোর প্রতি সায় আছে। সরকারদলীয় নেতাদের কথা হলো সঞ্চয়পত্রের সুদ যদি আগের মতো ১৩ শতাংশের মতো হতো, তাহলে সরকারের জনপ্রিয়তা অনেক বেড়ে যেত। সে হিসাবে, নির্বাচনি বছর হিসেবে এখনই মোক্ষম সময় সঞ্চয়পত্রের সুদ বাড়ানো। অপরদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কথা হলো সঞ্চয়পত্রের সুদ বাড়ালে মানুষ ব্যবসাবাণিজ্য বাদ দিয়ে জমাকৃত অর্থ সব সঞ্চয়পত্র কেনার কাজেই ব্যয় করবে। এতে দেশে অর্থনৈতিক স্থবিরতা দেখা দেবে, ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে পড়বে।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, উভয় দিক ঠিক রাখার জন্য সঞ্চয়পত্রের সুদ কমপক্ষে ১২ শতাংশ হওয়া উচিত এবং তা চলতি অর্থবছর থেকেই কার্যকর করা উচিত। এতে সরকারের জনপ্রিয়তাও বাড়বে এবং মাত্র ১ শতাংশ সুদ বাড়ানোর কারণে তা অর্থনৈতিক স্থবিরতায় তেমন নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ