যে কারণে পুঁজিবাজারে দরপতন

 নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের ধস হতে পারেÑ এমন আশঙ্কায় পুঁজিবাজারে বড় ধরনের দরপতন হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও বাজারকে ঠিকভাবে সাপোর্ট দিতে পারছে না তারল্যের অভাবে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ব্যাংকের ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) কমানোর ফলে পুঁজিবাজারে তারল্য কমতে শুরু করে। ফলে দরপতন ঠেকানোর মতো পর্যাপ্ত সক্ষমতাও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কমে আসে। তবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বা এডিআর কমানোর আশঙ্কায় এতটা দরপতনকে অতিরিক্ত প্রভাবিত (ওভার রিঅ্যাক্ট) হওয়া বলে আখ্যা দিচ্ছেন বাজার বিশ্লেষকরা।


অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মধ্যে সমন্বয় না থাকায় দফায় দফায় পুঁজিবাজারে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। পরস্পর সম্পর্কিত হওয়ায় মুদ্রাবাজার নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্তে প্রভাবিত হয় পুঁজিবাজার। অভিযোগ রয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে কোনো সমন্বয় ছাড়াই মুদ্রাবাজার বিষয়ে নানা সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে সৃষ্ট অস্থিরতা ও টালমাটালে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা।

পুঁজিবাজার প্রভাবিত বিষয়ে মন্তব্য, সিদ্ধান্ত কিংবা সার্কুলার জারি করতে বা মতামত দিতে বিএসইসির সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় সার্কুলার জারি করে ২০১২ সালে। সেই নির্দেশনার কোনো বাস্তবায়ন দেখছেন না পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা। পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা রক্ষায় উভয় পক্ষের সমন্বয় খুবই জরুরি অভিহিত করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘পুঁজিবাজার স্পর্শকাতর বিষয়। আমাদের পুঁজিবাজারে প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ব্যক্তি বিনিয়োগকারী বহুগুণ বেশি। তাদের পুঁজিও তুলনামূলক কম। পুঁজিবাজার নিয়ে কোনো তথ্য শুনলেই জেনে না জেনে শেয়ার বিক্রি করে। আর শেয়ার বিক্রির চাপে পুঁজিবাজারে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়।’

সম্প্রতি বেপরোয়া ঋণের লাগাম টানতে ব্যাংকের ঋণ আমানত হ্রাস করে এক সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও সার্কুলার জারির আগেই এই তথ্য জেনে শেয়ারবাজার অস্থির হয়ে ওঠে। পুঁজিবাজারে দরপতন ঘটে। আর সুপরিকল্পিতভাবে কারসাজি করার লক্ষ্যে একটি গোষ্ঠী এ বিষয়ে নানা তথ্য ছড়িয়ে ভীতি সৃষ্টি করেছে। ওই গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য থাকেÑ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা কম দামে শেয়ার বিক্রি করে দিলে তারা সেই শেয়ার কিনে মুনাফা অর্জন করবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি ঘোষণা ও এডিআর কমানো নিয়ে আতঙ্কে শেয়ার বিক্রির চাপে বাজারে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা জরুরি সভা করেছেন। সর্বশেষ ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএসইসি, আইসিবি ও সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বৈঠক হয়েছে।

২০১০ সালে ধসের পর দীর্ঘ ৬ বছরের মন্দাবস্থা কাটিয়ে গত বছরের শুরুতে ঊর্ধ্বমুখী গতি ফিরে পায় পুঁজিবাজার। মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় ঊর্ধ্বমুখী পুঁজিবাজারে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারি না বাড়লে ‘প্রলুব্ধ’ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে আইনকানুনের ব্যত্যয় ঘটালে ব্যবস্থা নেয়ারও কথা বলেন তিনি। তবে তার এই ঘোষণায়ও বাজারে অস্থিরতার সৃষ্টি হয় বলে জানা গেছে।

ব্যাংকগুলো বেঁধে দেয়া বিনিয়োগসীমা অতিক্রম করায় গত অক্টোবরে ৭টি ব্যাংককে জরিমানা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন জানানো হয়, আরো কয়েকটি ব্যাংক এই সীমা অতিক্রম করেছে। তাদেরও জরিমানা করা হবে। এই ঘোষণায় ভীতির সৃষ্টি হলে বাজার নিম্নমুখী হয়।

দরপতনের কারণ সম্পর্কে বিশিষ্ট পুঁজিবাজার বিশ্লেষক শামসুল আলম বলেন, প্রতিদিনই সূচক কমছে। একদিনে এত বেশি সূচক কমে যাওয়ার তেমন কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এডিআর (ঋণ আমানত অনুপাত) কমানোর কারণে ব্যাংকে আমানতের সুদের হার বাড়বে। ফলে পুঁজিবাজার থেকে কিছু টাকা ব্যাংকে চলে যাওয়া স্বাভাবিক। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রা সরবরাহে কিছুটা সংকোচনের ইঙ্গিত দিয়েছে। এর প্রভাব রয়েছে বাজারে। আর খালেদা জিয়ার মামলার রায়কে কেন্দ্র করে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, বাজারে এরও নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। তবে ২০১৪ সালে রাজনীতিতে ব্যাপক অস্থিতিশীলতা দেখা দিলেও বাজারে এত দরপতন হয়নি। তাই এসব কারণে এত বেশি দরপতন হওয়ার কথা নয়।

এদিকে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের চার কার্যদিবসে ২৮৮ পয়েন্ট সূচক হারানোকে বাজার ধস বলা যায় কি না স্বদেশ খবর-এর এমন প্রশ্নের জবাবে শামসুল আলম বলেন, ধস হওয়ার আগে বাবল হতে হয়, বাজারে এমন কোনো বাবল হয়নি। তাছাড়া টানা ৪-৫ দিন ব্যাপক দরপতন হলে তাকে ধস বলা যেতে পারে। সে হিসাবে এখনই একে বাজার ধস বলা ঠিক হবে না। কারণ ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রতিদিনই বড় ধরনের দরপতন হয়নি।

জানা যায়, ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে ধস নামার পর ২০১২ সালে ২২ ফেব্র“য়ারি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এক নির্দেশনায় বলা হয়, পুঁজিবাজার সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বা বক্তব্য দেয়ার ক্ষেত্রে বিএসইসির সঙ্গে আলোচনা, পরামর্শ ও সমন্বয় করতে হবে। বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাজার একটি সংবেদনশীল বাজার হিসেবে স্বীকৃত। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোর পুঁজিবাজার সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত না হয়ে বিভিন্ন বক্তব্য ও মন্তব্য প্রদানের কারণে বাজার প্রভাবিত হওয়ার ফলে পুঁজিবাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে।

বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে একটি স্থিতিশীল পুঁজিবাজার গঠনে কাজ করছে কমিশন। আইনকানুনে নানামুখী সংস্কার করে পুঁজিবাজারে নতুন নতুন পণ্য আনার চেষ্টা হচ্ছে। ব্যক্তি বিনিয়োগকারীকে আর্থিকভাবে সচ্ছল করতে দেশব্যাপী আর্থিক সচ্ছলতা কর্মসূচি চলছে। এতে বিনিয়োগকারী যেমন জেনেশুনে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে পারছে, তেমনি নতুন নতুন বিনিয়োগকারীও সৃষ্টি হয়েছে। ২০১০ সালে ধসের পর ধীরে ধীরে বর্তমানে স্থিতিশীল বাজারের পথে এগিয়ে পুঁজিবাজার। কিন্তু সমন্বয় না থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তে বাজারে বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে।

এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক শামসুল আলম বলেন, সরকার নির্দেশনা দিয়েছে পুঁজিবাজার বিষয়ক কোনো মন্তব্য বা সিদ্ধান্তে কমিশনের সঙ্গে সমন্বয় করতে। কাজেই এ ধরনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত বা আলোচনার প্রসঙ্গ এলে কমিশনকে জানানো প্রয়োজন। কিন্তু কমিশনকে কেউ অবহিত করে না। কমিশন কিভাবে জানবে কারা কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। কমিশনকে আগে জানানো হলে সমন্বয় করে সিদ্ধান্ত নেয়ার ফলে বড় ধরনের দরপতন এড়ানো সম্ভব হয়।

Post a Comment

0 Comments