সফল রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রয়োজন যোগ্য নেতৃত্ব : গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব বিকাশে অপরিহার্য ছাত্র সংসদ নির্বাচন

 মেজবাহউদ্দিন সাকিল

সফলভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজন দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্ব। আর যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি হয় স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। গণতান্ত্রিক চর্চার অনুঘটক হিসেবে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সাধারণত এ ধরনের নেতৃত্ব তৈরি হয়। তাই যোগ্য ও মেধাবী ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরির স্বার্থে দেশের সকল শিাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন জরুরি।


কিন্তু বাস্তবতা হলো নানা কারণে দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন সংঘটিত হচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন (ডাকসু) দীর্ঘ ২৮ বছর অনুষ্ঠিত হয়নি। সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে। ২০০৭ ও ২০০৮ সাল বাদ দিয়ে ১৯৯০ সালের পর থেকে দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান থাকলেও সারাদেশের অধিকাংশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। অথচ বাংলাদেশের রাজনীতিতে যখন গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রয়েছে, তখন দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির কারখানা হিসেবে পরিচিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ রেখে ছাত্ররাজনীতির সুষ্ঠু চর্চা ও বিকাশে কেন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে Ñ তা অনেকেরই বোধগম্য নয়।

শিার্থীদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায়, প্রতিভাবান ও যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি, মুক্তবুদ্ধি চর্চা, জাতির ক্রান্তিলগ্নে অগ্রণী ভূমিকা পালন ও জাতি গঠনমূলক কাজে ছাত্র সংসদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ছাত্র সংসদের নেতারা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ জাতির প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ার কারণে ১৯৯০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই ধরনের নেতৃত্ব আর পাওয়া যায়নি।

গণতন্ত্রের বিকাশে মুক্তবুদ্ধি চর্চার কোনো বিকল্প নেই। অথচ সিকি শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে মুক্তবুদ্ধিচর্চার সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত ডাকসু, চাকসু, জাকসু, রাকসু, অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ও কলেজগুলোতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ, আবাসিক হল ও বিভাগগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হচ্ছে না।

আর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারটি যখন সবাই প্রায় ভুলতে বসেছিল, ঠিক তখন দীর্ঘ ২৮ বছর পর সরকার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি সেন্ট্রাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন-ডাকসু’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তার কথা অনুধাবন করে। ফলে দীর্ঘ ২৮ বছর পর অবশেষে আগামী ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ডাকসু নির্বাচন।

অবশ্য ডাকসু নির্বাচন এমনি এমনিই অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। এর জন্য সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলন করতে হয়েছে, বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্রসংগঠনকে এগিয়ে আসতে হয়েছে, আইনি জটিলতা কাটিয়ে উঠতে হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সদিচ্ছা দেখাতে হয়েছে এবং সরকার সদিচ্ছা দেখিয়েছে। ১১ মার্চ ডাকসু নির্বাচন ভালোয় ভালোয় সম্পন্ন হলে আশা করা যায় অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদ নির্বাচনেরও অর্গল ভেঙে যাবে।

কী কারণে দীর্ঘদিন ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ ছিল; তা অনুসন্ধানে গেলে অনেক কিছুই হয়ত বেরিয়ে আসবে। তবে মোটা দাগে বলা যায়, স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ছাত্র সংগঠনের নেতারা চান না ছাত্র সংসদ সচল থাকুক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্র সংসদ সচল করে তাদের একতরফা কর্মকা-ের পথে বাড়তি ঝামেলা চায় না বলেই হয়ত দিনের পর দিন ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে নিরুৎসাহিত করে গেছে। অথচ এই সময়ে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক সমিতি নির্বাচন কিন্তু ঠিকই অনুষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষকরা তাদের অধিকার আদায়ে গণতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করলেও ছাত্রদের অধিকার আদায়ের পথটি করে রাখছিলেন রুদ্ধ। ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে এই রুদ্ধ দুয়ার খুলছে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাড়াও বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের যেসব ছাত্রনেতা আছেন, তারা শিক্ষার্থীদের ভোটে এমনকি দলীয় কর্মীদের ভোটেও নির্বাচিত নন; তারা সংগঠনের নেতা হয়েছেন দলীয় হাইকমান্ডের আশীর্বাদে। তারা ভালো করে জানেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন যদি দেয়া হয়, হাজার হাজার শিার্থীর মন জয় করে ভোটে নির্বাচিত হতে পারবেন না। কেননা, সেই ইমেজ ও গ্রহণযোগ্যতা তাদের নেই। আর যদি নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্র সংসদ গঠিত হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংগঠনের নেতাদের কর্তৃত্ব থাকবে না। তাই ছাত্রনামধারী নেতারাই ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

পুঁথিগত জ্ঞানার্জন আর সনদপ্রাপ্তিই কেবল উচ্চশিার মূল ল্য হতে পারে না। পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানার্জনের জন্য আরো অনেককিছু জানা অত্যাবশ্যক। উচ্চশিার বিষয়টি আরো ব্যাপক। পরিপূর্ণ জ্ঞানার্জনের জন্য প্রয়োজন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও মানবিক গুণাবলির বিকাশ। শিাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রসমাজের এসব অনুষঙ্গ পূরণ করতে প্রয়োজন ছাত্র সংসদ।

শিার্থীদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া তুলে ধরার প্ল্যাটফরম হচ্ছে ছাত্র সংসদ। ছাত্র সংসদের নেতারা শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য যে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করেন, সেখান থেকেই এক বা একাধিকজন হয়ে ওঠেন ছাত্রনেতা। শিক্ষাজীবন শেষ করে সেই ছাত্রনেতা যখন রাজনৈতিকজীবনে প্রবেশ করেন, তখন শিক্ষাজীবনের অভিজ্ঞতা তাকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদানে ক্রমেই যোগ্য করে তোলে। পরবর্তীতে তিনি জাতীয় পর্যায়ের নেতা হয়ে ওঠেন। যেমন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে অনেক মন্ত্রী ও শীর্ষ পর্যায়ের অনেক রাজনৈতিক নেতাই অতীতে ছাত্ররাজনীতি করে বর্তমানের গৌরবোজ্জ্বল আসন অলঙ্কৃত করতে সক্ষম হয়েছেন।

তবে অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, রাজনীতি এখন চলে গেছে ব্যবসায়ীদের হাতে। যে যত বড় ব্যবসায়ী, তিনি তত বড় নেতা অথবা তত বড় নেতা হতে চান। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক মনোভাব নিয়ে দেশসেবা আর ব্যবসায়িক মনোভাব নিয়ে দেশসেবার মধ্যে রয়েছে বিশাল তফাৎ। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে যোগ্য রাজনৈতিক নেতা বেরিয়ে না আসায় রাজনীতি হয়ে গেছে কলুষিত। সুবিধাবাদী রাজনীতি প্রকট হয়েছে। টাকার বিনিময়ে নেতৃত্বের স্বাদ পাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-গরিমায় সমৃদ্ধ মানুষের রাজনীতিতে আগমনের ঝোঁক ক্রমেই কমছে। কারণ, কথিত আছে যে, এখনকার সময়ে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য অনেক টাকা খরচ করতে হয় অথবা প্রচুর টাকা নানা জায়গায় বিনিয়োগ করতে হয়।

শিার্থীরা প্রতিনিয়ত নানামুখী সমস্যার মুখোমুখি হয়। অপর্যাপ্ত পরিবহন, লাইব্রেরিতে বইসংকট, হলে সিট না পাওয়া, হল ক্যান্টিনে নিম্নমানের খাবার ইত্যাদি সমস্যা তাদের নিত্যসঙ্গী। ছাত্র সংসদ না থাকায় এসব সমস্যা কর্তৃপরে কাছে তুলে ধরার কোনো মাধ্যম নেই সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের। সাধারণ শিার্থীদের কোনো প্ল্যাটফরমে দাঁড়ানোর সুযোগ নেই। নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও শিার্থীদের কোনো প্রতিনিধি নেই। ফলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিার্থীরা গত দুই যুগের বেশি সময় ধরে বঞ্চিত হচ্ছিল তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে।

এই দীর্ঘ সময়ে ছাত্রনামধারী নেতারা ছাত্রদের কল্যাণ করার পরিবর্তে নিজেদের আখের গোছানোর কাজেই ব্যস্ত ছিল। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হল দখল, ফাও খাওয়াসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিল তারা। ছাত্র সংসদ সচল থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রনামধারী বহিরাগতরা বিতাড়িত হতে বাধ্য হতো। ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল সোনালি সেই অতীত পুনরুদ্ধার হতো। রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে, বিশেষ করে রাজনৈতিক দল পরিচালনায় যোগ্য ও মেধাবী নেতৃত্বের যে চরম সংকট চলছে, তা দূর হতো। অতীতে রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি সর্বসাধারণের যে শ্রদ্ধাবোধ ছিল, সেই প্রবণতা আবার জেগে উঠতো।


দুই.

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদই ছিল ভবিষ্যৎ নেতা নির্মাণের সূতিকাগার। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে নিজ যোগ্যতায় তৃণমূল থেকে ধাপে ধাপে রাজনীতিতে সফল হওয়ার সুযোগ থাকে। স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশেও তাই ছিল। ছাত্ররাজনীতি থেকেই উত্থান হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর মতো নেতার। কিন্তু আশির দশক থেকে দলীয় রাজনীতির দাপটে এ সুযোগ হয়ে পড়ে চরমভাবে সীমিত। তবে এ সীমাবদ্ধতার মধ্যেও গণতান্ত্রিকভাবে নিজ যোগ্যতায় নেতা হওয়ার সবচেয়ে বড় সুযোগ ছিল ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন। ডাকসু, চাকসু বা জাকসুর নেতারা তাই পরে ধাপে ধাপে হয়ে উঠতেন জাতীয় পর্যায়ের নেতা। ডাকসুসহ বিভিন্ন ছাত্র সংসদের নির্বাচন না থাকার কারণে বহু বছর ধরে সেই সুযোগ বিলুপ্ত ছিল। এই সময়ে যেসব শিক্ষার্থী পাস করে কর্মস্থলে চলে গেছেন, তাদের উচ্চ শিক্ষাজীবনে রাজনীতির কোনো চর্চাই ছিল না। ফলে তাদের মধ্যে কোনো দেশপ্রেমই গড়ে ওঠেনি। সুবিধাবাদী মনোভাব এভাবেই ডালপালা বিস্তার করে প্রায় সব সেক্টরেই দুর্নীতি হয়ে পড়েছে অনিবার্য।

এখন বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা মনোনীত হন দলপ্রধানের অঙুলি হেলনে, বড়জোর মূল দলের বড় কিছু নেতার তদবিরে। সঠিক নেতৃত্ব বিকাশের অভাবেই দেশ আজ দুর্নীতির মতো সংকটে জর্জরিত।

এ সংকট থেকে উত্তরণে ছাত্রসমাজকে রাজনীতির মূলধারায় সম্পৃক্ত না করার কোনো বিকল্প নেই। সমাজের চলমান য়কে রুখতে এবং জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে সবার আগে সক্রিয় করতে হবে আমাদের ছাত্রসমাজকে। তাদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে দেশপ্রেমের অগ্নিমশাল। আর সেই কাজটি করতে পারে সমাজে সঠিক রাজনৈতিক চর্চা। রাজনৈতিক চর্চার প্রধান প্রতিষ্ঠানই হলো ছাত্র সংসদ। দিনের পর দিন সে ছাত্র সংসদ না থাকায় সমাজে রাজনৈতিক চর্চা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে সামাজিক দুর্নীতি কেবলই বাড়ছে।

এেেত্র পথপ্রদর্শক এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের মেরুদ- হিসেবে কাজ করতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাজ কেবল নিয়ম করে রুটিনমাফিক কাস বা পরীা পরিচালনা করা নয়। একজন ছাত্রের মননের বিকাশকে নিশ্চিত করাও তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আজকে ছাত্রদের সামনে কোনো ইতিবাচক আদর্শ নেই। সঠিক ও সুস্থ আদর্শের চর্চা নেই। নেই দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার মতো কোনো কার্যক্রম। তাই দেশকে এগিয়ে নিতে এবং যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। এ নির্বাচন শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধি থাকলে ভবিষ্যতে অবশ্যই দেশে গড়ে উঠবে সৎ ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব।


তিন.

ছাত্রসংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলের সহযোগী সংগঠন, এমন হিসাব তাত্ত্বিক কথা ছাড়া আর কিছুই না। স্বাধীনতার আগেও ছাত্রসংগঠনগুলো বৃহত্তর রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বেই চলতো। যারা এসব তাত্ত্বিক কথা বলেন, তারা গণতন্ত্রকেই বাধাগ্রস্ত করতে চান। গণতন্ত্রকে অবারিত করতে হলে ছাত্রসংগঠনকে সহযোগী সংগঠন বলার দিন ফুরিয়ে এসেছে। এখন সময় এসেছে তাদেরকে রাজনৈতিক দলের অপরিহার্য সংগঠন বলার।

প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির ল্য কী? আর অনেক ছাত্র সংগঠনে বছরের পর বছর নতুন কমিটি হয় না। অছাত্রদের দিয়েই চলে ছাত্রসংগঠন।

স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির চেহারা কেমন হওয়া উচিত Ñ এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত হলো, ছাত্ররাজনীতি তার মূল ল্য থেকে সরে গেছে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক শাসকরা টিকে থাকার জন্য ছাত্রদের দলে টেনে তাদের হাতে অবৈধ অস্ত্র ও অর্থ তুলে দিয়েছে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সামরিক শাসকরা সরাসরি এই কাজটি করেছেন। ফলে ছাত্ররাজনীতি এখন আর ছাত্ররাজনীতিতে নেই। তারা ল্যচ্যুত হয়েছে। তারা ছাত্রদের বিষয় নিয়ে কাজ করে না। তারা এখন বিত্তবান, মতাবান। মেধাবী ছাত্ররা ছাত্ররাজনীতিতে নেই। সাধারণ ছাত্রদের রাজনীতির প্রতি তৈরি হয়েছে এক ধরনের অনীহা।

বর্তমান ট্রেন্ড হলো যে দল ক্ষমতায় থাকে, তাদের ছাত্রসংগঠনই প্রভাব বিস্তার করে। ছাত্রসংগঠগুলো দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকায় মতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন প্রভাব বিস্তার করতে সব রকম সহযোগিতা পায় এবং রাজনৈতিক নেতারাও ছাত্রসংগঠনের নেতাদের নানা সুযোগ-সুবিধা দেয়ার পাশাপাশি তাদের নানা কাজে ব্যবহার করে থাকে।

এর ফলে বিত্তের ছোঁয়া এখন ছাত্ররাজনীতিতে। কোনো ছাত্রনেতা যদি তার মেধা ব্যবহার করে ধনী হয়, তাহলে কারোরই আপত্তি থাকার কথা নয়। সে প্রকৃতির ধনীর মাঝেই সন্নিবেশিত থাকে মেধা-মনন, মুক্তবুদ্ধির চেতনা আর দেশপ্রেম। কিন্তু এ কালের ছাত্রনেতারা এখন ছাত্ররাজনীতি করে ছাত্রাবস্থায় প্রাডো-লিমুজিন হাঁকিয়ে টেন্ডার দাখিল করতে যায়, হাইরাইজ ফ্যাটে থাকে, শেরাটনে ডিনার-সাপার সারে। দেশপ্রেম তাদের মধ্যে থাকে না মোটেও। দেশের উন্নয়নের চেয়ে নিজের উন্নয়নই তাদের কাছে হয়ে ওঠে বড়। এসবের ফলস্বরূপ দেশে ধনী পলিটিসিয়ান যে হারে গড়ে উঠেছে, ত্যাগী পলিটিসিয়ান সে হারে তৈরি হয়নি। আমাদের ছাত্ররাজনীতিতে সেই ধরনের ধনী ছাত্রনেতা প্রয়োজন, যারা মানসিকতায় ধনী, দেশপ্রেমে ধনী।


চার.

ছাত্রনেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লাশ পড়ে Ñ শুধু এই জুজু দেখিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হচ্ছে না। আবার অনেকে বলছেন, নীতিনির্ধারকদের গুরুত্বহীনতার কারণেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের ছাত্র সংসদ শক্ত ভিতের ওপর এখনও দাঁড়াতে পারেনি। এমনকি দিনের পর দিন ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় ছাত্ররাজনীতি এখন প্রশ্নবিদ্ধ।

অথচ জাতি আশা করে, ছাত্ররাজনীতি হবে স্বাধীন। তারা কোনো দলের লেজুড়বৃত্তি করবে না। তারা ছাত্রদের নিয়ে কাজ করবে। তাহলে ছাত্ররাজনীতি আবার গৌরবের মূল ধারায় ফিরবে। জাতির প্রয়োজনে তারাই মাঠে থাকবে।

বাংলাদেশে নেতৃত্বের সংকট কথাটি প্রায়ই শোনা যায়। আরো শোনা যায়, ব্যবসায়ী ও আমলা দিয়ে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভরে গেছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় দুটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বেই এখন আমলা ও ব্যবসায়ীদের আধিক্য ল্য করা যায়। জাতীয় সংসদে বর্ন পলিটিসিয়ান, আমলা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে কোন শ্রেণির পার্সেন্টেজ কত Ñ এমন হিসাব করতে গিয়ে দেখা গেছে, আমলা ও ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ৫০ শতাংশ অতিক্রম করেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক মহল আশঙ্কা প্রকাশ করছে, এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন রাজনৈতিক দলসমূহের নেতৃত্বে বিশেষ করে জাতীয় সংসদ সদস্যদের মধ্যে আমলা ও ব্যবসায়ীদের সংখ্যা সার্বণিক পলিটিসিয়ানদের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে।

কেন এমন হচ্ছে? এই প্রশ্ন এখন অনেক পলিটিসিয়ান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীকে ভাবিয়ে তুলছে। তাদের ীণ কণ্ঠে যেসব কথা উঠে এসেছে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তৃণমূল থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব সৃষ্টি হওয়া, সেটি বিকশিত ও পরিপক্ব হওয়ার প্রক্রিয়া থেমে গেছে। এই প্রক্রিয়ারই একটি হলো দেশের উচ্চশিা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়া।

রাজনৈতিক নেতৃত্ব একদিনে সৃষ্টি হয় না। এটি একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই নেতৃত্ব অভিজ্ঞ ও পরিপক্ব হয়। সেই প্রক্রিয়াটি শুরু হয় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতি থেকে। যারা দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি, বিশেষ করে দলীয় রাজনীতি নিয়ে স্টাডি করেছেন, তারা দেখতে পেয়েছেন, ভবিষ্যতে যারা রাজনীতিতে স্থায়ী হয়েছেন তাদের রাজনৈতিক জীবনের শুরুটা হয় ছাত্রজীবন থেকেই।

পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলের ছাত্ররাজনীতি এবং দলীয় রাজনীতি পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, ছাত্রজীবনে যিনি বা যারা যে ছাত্রসংগঠন করেছেন পরবর্তী জীবনে তারা সেই ছাত্র সংগঠনেরই মাদার অর্গানাইজেশন বা প্যারেন্ট অর্গানাইজেশনে যোগ দিয়েছেন। ছাত্রজীবনে যারা ছাত্রলীগ করেছেন, ছাত্রজীবন শেষ হলে তারা আওয়ামী লীগ করেছেন। আবার ছাত্রজীবনে যারা জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল করেছেন, পরবর্তী জীবনে তারা বিএনপি করেছেন এবং তাদের ক্ষেত্রে ডিগবাজি ও সুবিধাবাদী রাজনীতির প্রবণতা খুবই কম। বরং যারা আমলা বা ব্যবসায়ী, তারাই ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক স্বার্থের কারণে রাজনীতি করতে গিয়ে বারবার দল বদল করেছেন।

তারপরও ছাত্ররাজনীতিকে বাংলাদেশে যথাযথভাবে বিকশিত হতে দেয়া হয়নি। এই বিকাশের কাজটিকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন পঁচাত্তর-পরবর্তী সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। তিনি ছাত্ররাজনীতিতে ছাত্রলীগের একক অধিপত্য খর্ব করার জন্য মেধাবী ছাত্রদের নিজ ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলে টেনে নিয়েছেন। ধনী হওয়ার পথ দেখিয়ে তাদের রাজনৈতিক নেতা হওয়ার পরিবর্তে বানিয়েছেন ব্যবসায়ী। পঁচাত্তর-পরবর্তী সেই ধারাটি পরিপক্ব হতে হতে আজ জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ী ও আমলা প্রতিনিধি মোট সাংসদের অর্ধেক।

ব্যবসায়ীদের কবল থেকে রাজনীতিকে উদ্ধার করতে হলে রাজনীতির সূতিকাগার ছাত্ররাজনীতিকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিতেই হবে। ছাত্ররাজনীতি যেখানে স্থবির হয়ে পড়ে সেখানে স্রোতহীন পানির মতো আগাছা জন্মে বা শ্যাওলা পড়ে। তখন রাজনীতির মধ্যে ঢুকে পড়ে আমলা, ব্যবসায়ী ও সুবিধাবাদীরা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্থপতি। তার মাথার চুল থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত ছিল রাজনীতি। তার সময়ে আওয়ামী লীগ ছিল শত ভাগ পলিটিসিয়ানদের। সে জন্যই তিনি ও তার দল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে সফলভাবে নেতৃত্ব দিতে সম হয়েছিলেন। সেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরই দেশের রাজনীতি কলুষিত হতে শুরু করে। সেইসঙ্গে ছাত্ররাজনীতিও। এখন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সেই কলুষিত রাজনীতি ও ছাত্ররাজনীতিকে নিষ্কলুষ করার মিশনে নেমেছেন। সেই মিশনেরই একটি হলো ডাকসু নির্বাচন।

পাঁচ.

১১ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে ডাকসু নির্বাচন। এই নির্বাচনের মাধ্যমে দীর্ঘ ২৮ বছর পর আবার যোগ্য নেতৃত্ব তৈরির প্রাথমিক কাজ শুরু হবে। ডাকসু নির্বাচন সম্পন্ন হলে খুলে যাবে দেশের সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দ্বার। ছাত্রদের গঠনমূলক রাজনীতিতে মুখরিত হতে থাকবে দেশের সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস।

আপাদমস্তক পলিটিসিয়ান শেখ হাসিনা সেজন্য ডাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থাটি করেছেন। তিনি খুব কাছ থেকেই দেখছেন, ছাত্রাবস্থায় যারা রাজনীতি করেনি, রাজনীতি চলে যাচ্ছে তাদের দখলে। তিনি আরো দেখছেন, রাজনীতিতে অরাজনীতিকদের দাপট দিন দিনই বাড়ছে। এর ফলস্বরূপ গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের বিকাশ সংকুচিত হয়ে দুর্নীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বিশ্বাস করেন, রাজনীতি যেমন একদিনে কলুষিত হয়নি, তেমনি দুর্নীতিও একদিনেই সমাজে ডালপালা বিস্তার করেনি।

যে বিষয়গুলো একদিনেই ঘটেনি, সেগুলোকে নির্মূলের দ্রুত কোনো মাধ্যম নেই। দুদককে সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে হয়ত প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি কমিয়ে আনা যাবে, কিন্তু সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে, তাকে নির্মূল করবে কোন দুদক?

এই প্রশ্নেরও উত্তর জানেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেজন্য তিনি যেখান থেকে রাজনীতির হাতেখড়ি শুরু হয় সেখান থেকেই শুরু করেছেন। ডাকসু নির্বাচন দিয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দ্বার খুলে দিয়েছেন। আর এরই ধারাবাহিকতায় সারাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উপায়ে তৈরি হবে নতুন নেতৃত্ব।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ