নিজস্ব প্রতিবেদক
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ জটিলতা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে দেশের তৈরি পোশাক শিল্পখাত। বাতিল ও স্থগিতাদেশ হওয়া পোশাকের ক্রয়াদেশের পণ্য নিতে শুরু করেছেন বিদেশি ক্রেতারা। আবার নতুন করে আসছে ক্রয়াদেশও। এরই মধ্যে অনেক কারখানাতেই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাজ করার মতো পর্যাপ্ত ক্রয়াদেশ চলে এসেছে। ফলে করোনাভাইরাসের শুরুর দিকে বিপর্যস্ত রপ্তানি আয়ের শীর্ষ খাতটি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চলতি বছরের শুরু থেকেই বিপর্যয় শুরু হয় গার্মেন্টস শিল্পে। চীনের উহানে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার সাথে সাথে জানুয়ারি মাস থেকে বন্ধ হয়ে যায় গার্মেন্টস পণ্যের জাহাজিকরণ। ফলে ফেব্র“য়ারি মাসে দেখা দেয় কাঁচামালের সংকট। আর মার্চ এবং এপ্রিল মাসে আসতে থাকে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কার্যাদেশ স্থগিতের পাশাপাশি বাতিলের নির্দেশ। বর্তমানে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করেছে বলে মনে করছেন এ খাতের সংশ্লিষ্টরা। তবে যত দ্রুত সম্ভব চাহিদা অনুযায়ী পোশাক পাঠাতে পারবে, ততো বেশি কার্যাদেশ দেয়ার শর্ত দিচ্ছে বিদেশি ক্রেতারা।
বর্তমানে যে পরিমাণ ক্রয়াদেশ আসছে, সেটিকে অবশ্য মন্দের ভালো বলছেন পোশাকশিল্পের মালিকেরা। কারখানামালিকেরা জানান, গতবারের তুলনায় বর্তমানে ৭০-৮০ শতাংশ ক্রয়াদেশ আসছে, যা বর্তমান পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে সাহস জোগাচ্ছে। অনেকগুলো বড় ব্র্যান্ড স্থগিত ও বাতিল করা ক্রয়াদেশের পণ্য আবার নিতে শুরু করায় পোশাক রপ্তানি গত জুনেই বেশ খানিকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তবে বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস ও টিকা আবিষ্কার না হওয়ায় একধরনের অনিশ্চয়তা এখনো রয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে গত মার্চে সেখানকার বড় ক্রেতারা একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত করতে থাকেন। এদিকে দেশেও ভাইরাসটির সংক্রমণ রোধে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর মাসখানেক পোশাক কারখানা বন্ধ ছিল। তাতে এপ্রিলে মাত্র ৩৭ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়, যা গত দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। পরের মাসে রপ্তানি হয় ১২৩ কোটি ডলারের পোশাক। জুনে সেটি বেড়ে ২২৫ কোটি ডলারে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপরও বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ হাজার ৭৯৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়, যা তার আগের বছরের চেয়ে ৬১৮ কোটি ডলার কম।
১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রামের প্যাসিফিক জিনস গ্র“পের পাঁচটি কারখানা রয়েছে। করোনা সংক্রমণের মধ্যেও সদ্য বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে তারা রপ্তানি করেছে প্রায় ৪০ কোটি ডলারের পোশাক। তার আগের অর্থবছরের চেয়ে তাদের রপ্তানি কমেওনি, বাড়েওনি।
জানতে চাইলে প্যাসিফিক জিনসের পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে বিক্রয়কেন্দ্র খোলার পরপরই ক্রেতারা ক্রয়াদেশ দিতে শুরু করেছেন। আমাদের কারখানায় গতবারের চেয়ে বর্তমানে ৬০-৭০ শতাংশ ক্রয়াদেশ রয়েছে।’ তিনি বলেন, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ক্রয়াদেশ আছে। তারপরের ক্রয়াদেশও আসছে। তবে আসার গতিটা কম। অনেক সময় ক্রেতারা কারখানা বুকিং দেওয়ার পরও নানা কারণে শেষ পর্যন্ত ক্রয়াদেশ দেন না। ফলে কিছুটা অনিশ্চয়তা তো রয়েছেই।
এদিকে করোনায় একেবারে ক্রয়াদেশ কমেনি, এমন কারখানার খোঁজও পাওয়া গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুরোনো এক উদ্যোক্তা জানান, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ক্রয়াদেশ নিয়ে
দুশ্চিন্তা নেই তাঁর। গতবারের মতোই ক্রয়াদেশ রয়েছে কারখানায়। করোনায় ক্রয়াদেশ তো কমেনি, বরং নতুন দুটি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের ক্রয়াদেশ পেয়েছেন তিনি।
পোশাক খাতের আরেক বড় প্রতিষ্ঠান ঢাকার রাইজিং গ্র“প। তাদের পোশাক কারখানার সংখ্যা ৭টি। ওয়ালমার্ট, ইন্ডিটেক্স, প্রাইমার্ক, টার্গেট, কিয়াবি, কে-মার্টের মতো বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরি করা রাইজিং গ্র“পের রপ্তানির পরিমাণ বছরে ১৩ কোটি ডলার।
রাইজিং গ্র“পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘আমাদের সাতটি কারখানার মধ্যে ছয়টিতে ভালো ক্রয়াদেশ আসছে। সব মিলিয়ে গতবারের তুলনায় ক্রয়াদেশের পরিমাণ ৮০ শতাংশের কাছাকাছি। তা ছাড়া মার্চে বাতিল ও স্থগিত হওয়া সব ক্রয়াদেশের পণ্য ক্রেতারা নিতে শুরু করেছে। যদিও একটি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানকে ৪ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার মূল্যছাড় দিতে হয়েছে।’
উদ্যোক্তারা গতবারের তুলনায় ৭০-৮০ শতাংশ ক্রয়াদেশ প্রাপ্তির যে কথা বলছেন, তার সঙ্গে রপ্তানি আয়ের চিত্রও মিলে যাচ্ছে। পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সম্প্রতি জানিয়েছে, ১ থেকে ১২ জুলাই পর্যন্ত ৯৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ১১৯ কোটি ডলারের পোশাক।
করোনার প্রভাব কাটছে
গতবারের তুলনায় বর্তমানে ৭০-৮০ শতাংশ ক্রয়াদেশ আসছে তার সঙ্গে রপ্তানি আয়ের চিত্রও মিলে যাচ্ছে। মার্চে পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়ায় মালিকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লে সরকার রপ্তানিমুখী কারখানার শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। সেই তহবিল থেকে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কারখানার মালিক মাত্র ২ শতাংশ সেবা মাশুলে ঋণ নিয়ে তিন মাসের মজুরি দিয়েছেন। অন্যদিকে দুই মাসের ব্যবধানে পোশাক রপ্তানিতে গতি ফিরলেও ইতিমধ্যেই বেশ কয়েক হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করেছেন পোশাকশিল্প উদ্যোক্তারা। এপ্রিলে কারখানা বন্ধ থাকাকালে ৬৫ শতাংশ মজুরি দিয়েছেন। এমনকি শ্রমিকের ঈদ বোনাসেও হাত দিয়েছেন অধিকাংশ মালিক।
বিজিএমইএর তথ্যানুযায়ী, করোনায় ৩১৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানির ক্রয়াদেশ প্রাথমিকভাবে বাতিল ও স্থগিত হয়েছিল। তার মধ্যে প্রাইমার্ক ৩৩ কোটি, ইন্ডিটেক্স ৮ কোটি ৭০, বেস্টসেলার ৮ কোটি ৩০ লাখ, মাদারকেয়ার ৫ কোটি ৬০ লাখ, কোহলস ৫ কোটি ৪০ লাখ, গ্যাপ ৩ কোটি ৮০ লাখ, জেসি পেনি সাড়ে ৩ কোটি, ওয়ালমার্ট ১ কোটি ৯০ লাখ, ডেবেনহাম ১ কোটি ৮০ লাখ ও রালফ লরেন ১ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত করে (হিসাবটি আনুমানিক)।
পরবর্তী সময়ে নানামুখী চাপের কারণে অধিকাংশ ক্রেতাই পণ্য নিতে সম্মত হন। তবে অর্থ পরিশোধে ছয় মাস পর্যন্ত সময় চান অনেকে। সর্বশেষ ২ জুলাই লেভি স্ট্রজ ও তার কয়েক দিন পর গ্যাপ ইনকরপোরেশন বাতিল করা ক্রয়াদেশের পোশাক পূর্ণ দাম দিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ফলে ব্র্যান্ড দুটির ৩০-৪০টি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা কিছুটা হলেও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন।
বাংলাদেশি পোশাকের অন্যতম বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এইচঅ্যান্ডএম। সুইডেনভিত্তিক এই র্ব্যান্ড বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার বা ২৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার পোশাক কিনে থাকে। সেই হিসাবে ১০ শতাংশ বাংলাদেশি পোশাকের ক্রেতা হচ্ছে এইচঅ্যান্ডএম। করোনায় কোনো ক্রয়াদেশ বাতিল করেনি তারা। স্থগিত হওয়া ক্রয়াদেশের পণ্য নেওয়া শুরুর পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের কাছে কোনো মূল্যছাড়ও চায়নি। পোশাকের ক্রয়াদেশের দাম পরিশোধের শর্তেও কোনো রকম পরিবর্তন করেনি এইচঅ্যান্ডএম।
জানতে চাইলে এইচঅ্যান্ডএমের বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইথিওপিয়ার প্রধান জিয়াউর রহমান বলেন, ‘গত দুই থেকে আড়াই মাসে আমরা ৫০ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ দিয়েছি। আমাদের ৩০০ সরবরাহকারী কারখানার সবাই ক্রয়াদেশ পেয়েছে। এইচঅ্যান্ডএমের ক্রয়াদেশ পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্য প্রতিযোগী দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। চীন ও তুরস্ক থেকে যেসব ক্রয়াদেশ সরছে, তার একটি অংশ বাংলাদেশে আসছে। কারণ, বাংলাদেশে উৎপাদন খরচ তুলনামূলক কম।’
আগামী দুই-তিন মাসের পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে জিয়াউর রহমান আরও বলেন, ‘লকডাউনের পর বিক্রয়কেন্দ্র খুলেছে। কোনো কোনো দিন ভালো বিক্রি হচ্ছে। আবার কোনো দিন হচ্ছে না। ফলে প্রতি সপ্তাহে পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে হচ্ছে। তা ছাড়া লকডাউনের কারণে স্টক জমে গেছে। আমরা সেগুলো নিয়ে কাজ করছি। ফলে আগামী কয়েক মাস ক্রয়াদেশ কী পরিমাণ দেওয়া হবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়।’
বাংলাদেশি পোশাকের আরেক বড় ক্রেতা যুক্তরাজ্যভিত্তিক ব্র্যান্ড মার্ক্স অ্যান্ড স্পেনসার (এমঅ্যান্ডএস)। ব্র্যান্ডটির ১ হাজার ৪৬৩ বিক্রয়কেন্দ্রে গত বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১০০ কোটি ডলারের পোশাক গেছে। বর্তমানে এমঅ্যান্ডএসের পোশাক তৈরি করে দেশের ৫৫ জন সরবরাহকারী। কারখানার সংখ্যা ৮৩।
জানতে চাইলে এমঅ্যান্ডএসের বাংলাদেশ প্রধান স্বপ্না ভৌমিক বলেন, ‘করোনায় আমরা কাজের ধরন বদলে ফেলেছি। বিক্রয়কেন্দ্রে বিক্রি যে পরিমাণে হচ্ছে, সেই পরিমাণে ক্রয়াদেশ দিচ্ছি। নতুন ক্রয়াদেশের বেলায় আট সপ্তাহের বেশি সময় দিচ্ছি না। দ্রুত সরবরাহ করতে স্থানীয়ভাবে পোশাকের অনুমোদন দিতে শুরু করেছি আমরা। সেই সঙ্গে চীন থেকে কৃত্রিম তন্তুর সুতা আমদানি করে দেশেই কাপড় উৎপাদনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে গতবারের চেয়ে ৭০-৮০ শতাংশ ক্রয়াদেশ পাচ্ছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।’
দেশের পোশাক রপ্তানিতে আরেক বড় প্রতিষ্ঠান এনভয় গ্র“প। ১৯৮৪ সালে শুরু করা গ্র“পটির অধীনে রয়েছে ১৫টি পোশাক কারখানা। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিখ্যাত জারা, নেক্সট, সিঅ্যান্ডএ, কেলভিন ক্লেইন, আমেরিকান ইগল, ওয়ালমার্ট, ডিজনিসহ বেশ কয়েকটি র্ব্যান্ডের জন্য পোশাক সরবরাহ করে প্রতিষ্ঠানটি।
এনভয় গ্র“পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, যেসব ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হয়েছিল, সেগুলো ক্রেতারা নিচ্ছেন। অন্যদিকে নতুন ক্রয়াদেশ আসার যে প্রবণতা রয়েছে, সেটিও ইতিবাচক। যদিও জুলাই-আগস্ট লিংক পিরিয়ড, প্রতিবছরই মাস দুটিতে ক্রয়াদেশ কিছুটা কম থাকে। তিনি বলেন, সরবরাহকারীদের কাছে ক্রয়াদেশের চাহিদা বেশি থাকায় বর্তমানে বেশ প্রতিযোগিতা হচ্ছে। তাতে কিছু ক্রেতা গতবারের চেয়ে কম দাম দিচ্ছেন। তবে অধিকাংশই আগের দামে ক্রয়াদেশ দিচ্ছেন।
সাধারণ ছুটির মধ্যে কারখানা খুলে দেওয়ার মতো চ্যালেঞ্জিং সিদ্ধান্ত এবং শ্রমিকদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারায় পোশাক রপ্তানি ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী। তিনি বলেন, বড় কারখানাগুলো টিকে থাকার মতো ক্রয়াদেশ পেলেও ছোট ও মাঝারি কারখানা সেভাবে পাচ্ছে না। তাই অন্তত দুই মাস তাদের শ্রমিক-কর্মচারীর মজুরির জন্য সহায়তা দরকার।
0 Comments