দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রশাসনের জিরো টলারেন্স নীতি: সরকারের সময়োপযোগী সঠিক সিদ্ধান্তে

 মেজবাহউদ্দিন সাকিল

বলা হয়, ক্যাপিটেলাইজেশন বা মূলধনীকরণ বা বিনিয়োগ যদি মুদ্রার এক পিঠ হয়, তাহলে অন্য পিঠ হলো করাপশন বা দুর্নীতি। সরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে যখন কোনো কর্মকা- সম্পন্ন করতে যাওয়া হয়, তখন সে কাজটি থেকে অনৈতিক পন্থায় সুবিধা নেয়ার জন্য এক বা একাধিক পক্ষ সক্রিয় হয়। তখনই আসে করাপশনের প্রশ্ন। সে জন্যই বলা হয়, ক্যাপিটেলাইজেশন হলে করাপশন হবেই। তবে সে করাপশনের মাত্রাটিই হলো আসল বিচার্য বিষয়।


প্রশ্ন আসে, করাপশন হয় বলে কী ক্যাপিটেলাইজেশন হবে না? করাপশনের ভয়ে যদি ক্যাপিটেলাইজেশনই বন্ধ থাকে, তাহলে করাপশন হয়ত হবে না, কিন্তু কাজটিও তো হবে না। দুর্নীতিমুক্ত তকমা পাওয়ার জন্য কোনো কাজই না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? অর্থনীতি দাঁড়িয়ে থাকবে এক জায়গায়, কর্মহীন হয়ে পড়বে ওই কাজটির সঙ্গে জড়িতরা, গ্রস ডমেস্টিক প্রোডাক্ট বা জিডিপি কমতে থাকবে দ্রুত গতিতে। স্থবির হয়ে পড়বে সবকিছু।

তাই বলে কী সমর্থন দিতে হবে দুর্নীতিকে? অবশ্যই না। এখানেই দুর্নীতির মাত্রার বিষয়টি চলে আসে, আরো আসে দেশে দুর্নীতির মাত্রার পরিমাপের বিষয়টিও। তারও আগে প্রশ্ন আসে, দেশে দুর্নীতি হয় কি না, দুর্নীতি ছাড়া কোনো কাজ হয় কি না এবং দেশে যে দুর্নীতি হয়, তা সরকার স্বীকার করে কি না?


দুর্নীতির বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি

টানা তৃতীয়বার এবং মোট চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কথা ঘোষণা করেছেন। তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, আমরা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছি এবং এগুলো দমনে সফল হয়েছি। আমরা মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছি, সমাজ বা রাষ্ট্র থেকে মাদক নির্মূলে আমরা অনেকটাই সফল হয়েছি এবং দলমত নির্বিশেষে সারাদেশে মাদকবিরোধী অভিযান চলমান রয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছি, দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চলছে এবং আশা করি সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও মাদকের মতো দুর্নীতি প্রতিরোধেও আমরা সফলকাম হবো।

বিশ্বের দেশে দেশে শীর্ষ ব্যক্তির দ্বারা অনেক বড় অংকের দুর্নীতি সংঘটিত হওয়ার ঘটনা বিরল নয়। এসব ঘটনার বেশিরভাগই ধামাচাপা পড়ে যায়। দু-একটি দুর্নীতি নিয়ে মিডিয়া বেশ হইচইয়ে অবতীর্ণ হয়, যিনি দুর্নীতি করেছেন, তাকে পদ থেকে সরে যেতে হয়।

দুর্নীতির অভিযোগে যিনি বা যারাই করুন না কেন, একটা স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম হলো কোনো দেশের কোনো শীর্ষ ব্যক্তি কোনো দিনই স্বীকার করেন না যে, তার দেশে দুর্নীতি হয় বা তার সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত বা তিনি নিজেও দুর্নীতির ঊর্ধ্বে নন।

অথচ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। এর সরল অর্থ হলো তার সরকারের সময়ে ব্যাপক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশে কমবেশি যে দুর্নীতি হচ্ছে, তা শেখ হাসিনা অপকটে স্বীকার করে নিয়েছেন এবং এ ধরনের ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঘোষণা করেছেন জিরো টলারেন্স নীতি।

দেশে দেশে এ ধরনের সরল স্বীকারোক্তির সাহস কয়জনের আছে? বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার মতো সাহসী ও বিচক্ষণ নেতা সেই সাহস দেখিয়েছেন অবলীলায়। তিনি বলেছেন, দুর্নীতিকে কোনো অবস্থাতেই প্রশ্রয় দেয়া হবে না। দুর্নীতিবাজ যে দলের হোক, এমনকি তাঁর নিজ দলের হলেও রেহাই নেই।

বলা বাহুল্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক এই ঘোষণায় অস্বস্তিতে আছেন দেশের প্রভাবশালী হিসেবে চিহ্নিত অনেকেই। কিন্তু এতে খুশি দেশের সাধারণ মানুষ। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে তিনি কেবল হুঁশিয়ারি দিয়েই ক্ষান্ত হননি, নবনিযুক্ত মন্ত্রীদের উদ্দেশে বলেছেন, মন্ত্রিত্ব পেয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে অনেক সম্পদ হয়ত গড়তে পারবেন, কিন্তু পচে যাবেন।

মন্ত্রীদের যাতে রাজনৈতিকভাবে পচে যেতে না হয়, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের দুর্নীতিমুক্ত থাকতে বলেছেন। তিনি জানেন, মন্ত্রী দুর্নীতিমুক্ত থাকলে মন্ত্রণালয় পরিচ্ছন্ন থাকবে, মন্ত্রণালয় পরিচ্ছন্ন থাকলে আমলাশ্রেণি আদর্শবান হবেন, ঊর্ধ্বতন শ্রেণি আদর্শবান হলে অধঃস্তনের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা বজায় থাকবে। এর মাধ্যমে দুর্নীতি থাকবে সহনীয় পর্যায়ে।


দুর্নীতির রকমফের ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি

দুর্নীতি বহু প্রকারের। তবে মোটা দাগে দুর্নীতি দুই প্রকার – প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক দুর্নীতি। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি নির্মূলের জন্য সরকারের হাতে থাকে নানা মাধ্যম। এর অন্যতম হলো দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি কমিয়ে আনা। এ ধরনের দুর্নীতি কমিয়ে আনার জন্য সরকারপ্রধান সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করতে পারেন, মোটিভেট করতে পারেন, প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি কমিয়ে আনার জন্য সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে। সদিচ্ছার প্রাথমিক পর্ব হলো প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে যে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি হয়, তা আগে স্বীকার করা এবং সে মতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি হয় এবং আছে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। তিনি জানেন, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি কারা করেন এবং সে দুর্নীতি ওই প্রতিষ্ঠানটিকে কতটা দুর্বল করে তুলছে।

আবার ব্যক্তিকেন্দ্রিক দুর্নীতির সম্মিলিত রূপই হলো প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি। একটি কাজ সম্পন্ন করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের টপ লেভেল থেকে বটম ও ফিল্ড লেভেল পর্যন্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ে যে দুর্নীতি হয়, সে দুর্নীতিগুলোর যোগফলই হলো প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি। তিনটি লেভেল মিলেমিশে যে সম্মিলিত দুর্নীতির আশ্রয় নেয়, তার ব্যাপকতার ওপরই প্রতিষ্ঠানটি কতটুকু দুর্নীতিগ্রস্ত তা নির্ধারিত হয়। এই ব্যাপকতার মাত্রার হ্রাস-বৃদ্ধির কারণে প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে বিরাট পার্থক্য তৈরি হয়ে থাকে। মানুষ বলতে থাকে সরকারের অমুক প্রতিষ্ঠানটি সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত বা অমুক প্রতিষ্ঠানটি সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত।

প্রতিষ্ঠানপ্রধান থেকে শুরু করে পিয়ন Ñ সবার মানসিকতা যদি এমন থাকে যে, সুযোগ যখন পেয়েছি, এর সর্বোচ্চ সুবিধাটুকু নিয়ে নিই Ñ তখনই প্রতিষ্ঠানটির দুর্নীতিগ্রস্ততা ওপেন হতে থাকে। ওই প্রতিষ্ঠানে ঘুষ খাওয়া ও ঘুষ দেয়ার মধ্যে কোনো রাখঢাক থাকে না। ঘুষের রেটও নির্ধারিত থাকে অনেক প্রতিষ্ঠানে। মানুষ জেনে যায়, অমুক প্রতিষ্ঠান থেকে কোন কাজটি উদ্ধার করতে হলে কত ঘুষ দিতে হয় এবং কাকে কত দিতে হয়।

এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের মিড লেভেল হলো ঘুষের হর্তাকর্তা। ঘুষের রেট নির্ধারণ করে তারাই। রেট অনুযায়ী ঘুষ না পেলে তারা ফাইল আটকে দেয়। নির্ধারিত ঘুষ পেলেই এই লেভেল ফাইলের কাজ সম্পন্ন করে টপ লেভেলের কাছে পাঠায়। টপ লেভেল তার সিগনেচারটি দেয়ার সময় পরম যতেœ টুকে রাখে তিনি কত কত দামের কয়টি সিগনেচার দিলেন। দিনশেষে সিগনেচারপ্রতি ঘুষের টাকাটা বুঝে নিয়ে সেদিনের মতো অফিস ত্যাগ করতে পাজেরোতে গিয়ে চাপেন।

মিড লেভেল যে ঘুষ গ্রহণ করে, তা একা ভোগ করতে পারে না। টপ লেভেলের কাছে সিগনেচারপ্রতি ঘুষের টাকা পৌঁছে দিতে হয়। বটম লেভেলও ঘুষের খবর রাখে। তারা অল্প হলেও পায় ঘুষের ভাগ। বটম লেভেল আবার ঘুষদাতার কাছ থেকেও সরাসরি ঘুষ গ্রহণ করে। যদিও তারা একে ঘুষ না বলে ‘চা-পানের’ খরচ বলে থাকে। ঘুষদাতাকে মিড লেভেলের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে, ফাইলটি ছেড়ে দেয়ার জন্য মিড লেভেলকে তাগাদা দিতে, বড় সাহেবের কাছে ফাইলটি গেল কি না সে খবরটি ঘুষদাতাকে জানিয়ে এবং আরো অনেক ছোটোখাট কাজে তারা ঘুষ গ্রহণ করে। বটম লেভেল যে এ ধরনের ঘুষ প্রতি কর্মঘণ্টায়ই খায়, তা মিড লেভেল জানে বলে তাদের ঘুষের ভাগ কম দেয়া হয় এবং বটম লেভেল এটা মেনেও নেয়।

মিড লেভেল সবচেয়ে বেশি সচেষ্ট থাকে ঘুষের অর্থটি সঠিক সময়ে ও পরিমাণে টপ লেভেলের হাতে তুলে দিতে। মিড লেভেল জানে ঘুষের পরিমাণের রকমফের হলে টপ লেভেল চটে যাবে। আর শীর্ষ লেভেল চটে গেলে বা ঘুষবঞ্চিত হতে হতে ঘুষ খাওয়া ছেড়ে দিয়ে ভালো মানুষ হয়ে গেলে তখন মিড লেভেল পড়বে গভীর পানিতে। টপ লেভেলের রক্তচক্ষুর কারণে বিনা ঘুষে সমান পরিশ্রমে ফাইলের কাজ সম্পন্ন করে ওপরে পাঠাতে হবে।

ফাইল তৈরিতে ওপরওয়ালার যেহেতু সিগনেচার দেয়া ছাড়া কোনো পরিশ্রম নেই, সেহেতু তিনি ফাইলটি দেখবেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। সে আরেক বিপত্তি। ফাইল আবার ফিরে আসতে পারে মিড লেভেলে। আবার ফাইল নিয়ে বসতে হবে। অধিকতর সতর্কতার সঙ্গে কাজ সম্পন্ন করতে হবে। বিনা ঘুষে এক ফাইলের কাজ দুইবার করতে গিয়ে তখন মিড লেভেল প্রতিজ্ঞা করে, আবার যদি বড় সাহেবকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে ঘুষের রাস্তায় আনা যায়, তাহলে তার সঙ্গে আর ঘুষের ভাগ নিয়ে নয়-ছয় করা যাবে না। সরকারি চাকরি পেয়েছি, এজন্য বেতন নিই, অফিসে এসে কাজ করি, তাই ঘুষ খাই Ñ এই মানসিকতা পোষণ করে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের মিড ও বটম লেভেলই। এই লেভেল দুটি যখন দেখে যে বেতন নেয় বলে তাদের কাজ করতে হয়, তখনই তারা টপ লেভেলকে ঘুষের আওতায় আনার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। বলা যায়, প্রতিষ্ঠানের টপ লেভেলকে ঘুষের দিকে টেনে নেয়ার ক্ষেত্রে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করে মিড ও বটম লেভেল।

এই দুই লেভেলের সীমাহীন প্রচেষ্টা সত্ত্বেও টপ লেভেল যখন ‘বেতন নেন বলে কাজ করতে হবে’Ñ এই নীতিতে অটল থাকে তখন মিড ও বটম লেভেল কোমর কষে টপ লেভেলের চরিত্র হননের কাজে নামে। এই দুই লেভেল মিলে টপ লেভেলের বিরুদ্ধে এমন সব অবস্থার সৃষ্টি করে, পরিস্থিতি এমন কঠিন করে তুলে যে, প্রায় ক্ষেত্রেই টপ লেভেলকে পদ ঠিক রাখার জন্য আপসে আসতে হয়, মিড ও বটম লেভেলের কাজ করে বলে ঘুষ খাওয়া মেনে নিতে হয় এবং নিজেদেরও ঘুষ খেতে হয়।

একটা প্রতিষ্ঠানের তিন লেভেল মিলেই যখন ঘুষ খেতে শুরু করে অর্থাৎ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে যায় এবং তাদের ঘুষ খাওয়াটা যখন ওপেন সিক্রেট হয়ে দাঁড়ায়, তখন সরকার আসলে কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে দুর্নীতির ডালপালা ছাঁটা শুরু করবে?

যেকোনো প্রতিষ্ঠানেরই বটম লেভেলে কর্মীসংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তারচেয়ে কম মিড লেভেলে, তারও কম টপ লেভেলে। সরকারের পক্ষে সরাসরি সম্ভব নয় আর্দালি-চাপরাশি-বয়-বেয়ারা-মশালচি-মালি-পিয়ন-ড্রাইভারসহ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বিপুলসংখ্যক কর্মচারীর দুর্নীতি রোধ করা। সরকারের পক্ষে মিড লেভেলের দুর্নীতিও রোধ সম্ভব নয় তাদের সংখ্যাধিক্যের কারণে। তবে হ্যাঁ, সরকারের পক্ষে সংখ্যাস্বল্পতার কারণে টপ লেভেলের দুর্নীতি রোধ সম্ভব।

শেখ হাসিনা সরকারের উচিত হবে, সবার আগে সব প্রতিষ্ঠানের টপ লেভেলের সম্পদের হিসাব নেয়া এবং কারো অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদের হিসাব পেলে, সে যে-ই হোক না কেন, সম্পদ বাজেয়াপ্তসহ তার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

দুর্নীতি রোধে টপ লেভেলকে জবাবদিহিতার আওতায় আনলে এই লেভেলের শ্যেন দৃষ্টির কারণে আপনাআপনি মিড ও বটম লেভেলের দুর্নীতি কমে যাবে। ‘দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার’Ñ এই তকমা পাওয়ার ভয়ে কোনো প্রতিষ্ঠানের টপ লেভেলের দুর্নীতি যদি চেপে যাওয়া হয়, তাহলে সেখান থেকে কোনো সময়ই দুর্নীতি বিদায় নেবে না।

যেকোনো প্রতিষ্ঠানের টপ লেভেলের জন্য সতর্কবার্তা হলো প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে যে দুর্নীতি হচ্ছে, অন্যান্য সরকারের মতো শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার সে বিষয়টি চেপে যাওয়ার চেষ্টা করেনি এবং অনেক প্রতিষ্ঠানের টপ লেভেলই যে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, সে বিষয়েও সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ওয়াকিবহাল রয়েছেন। এজন্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন জিরো টলারেন্স।

যেকোনো প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিগ্রস্ত টপ লেভেলের বোঝা উচিত, সরকারপ্রধানের কাছ থেকে তারা দুর্নীতির বিষয়ে কোনো এক্সকিউজ পাবেন না। পাওয়ার আশা থাকলে দুর্নীতি নির্মূলে জিরো টলারেন্স ঘোষণা হতো না। টপ লেভেল দুর্নীতির বিষয়ে এক্সকিউজ পেলে সরকারের পক্ষ থেকে আসলে এ বিষয়ে কোনো কথাবার্তাই শুরু হতো না।

সরকারপ্রধান তার সম্যক ক্ষতির কথা জেনেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। দুর্নীতি রোধে আন্তরিক বলেই এ জাতীয় ঘোষণা দেয়া সম্ভব হয়েছে। এই ঘোষণার মধ্যে কোনো স্ট্যান্টবাজি নেই। কোনো প্রতিষ্ঠানের টপ লেভেল যদি মনে করে, ঘোষণাটি স্ট্যান্টবাজি বা রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য শেখ হাসিনা দিয়েছেন Ñ তাহলে বলতে হবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন।

শেখ হাসিনা বোকা নন। তা নন বলেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি আপসহীনতায় নেমেছেন। সুতরাং যেকোনো দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের টপ লেভেলের পার পাওয়ার কোনো উপায় নেই। শেখ হাসিনা তাদের ধরবেনই। ধরো তক্তা মারো পেরেক টাইপের ধরা নয়, ধৈর্যশীলতার মাধ্যমে চূড়ান্ত খোঁজখবর নিয়েই তিনি ধরা শুরু করবেন।

সুতরাং দুর্নীতি ছেড়ে দেয়ার বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের টপ লেভেলের আন্তরিক হতে হবে। তারা যদি আন্তরিক হন, তাহলে মিড ও বটম লেভেল দুর্নীতি না করার বিষয়ে আন্তরিক হবে। আর এভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে।


ব্যক্তিকেন্দ্রিক দুর্নীতি

অপ্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি হলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক দুর্নীতি। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি নির্মূলের জন্য দুদক আছে, কিন্তু ব্যক্তিক দুর্নীতি রোধে আদতেই কোনো সংস্থা নেই। উদাহরণস্বরূপ লোকোমেটিভ (ইঞ্জিন) ক্রয়ে রেলের টপ লেভেল দুর্নীতি করলে দুদক সে দুর্নীতি উদ্ঘাটনপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু কোনো যাত্রী যদি টঙ্গী থেকে ট্রেনে চেপে বিনা টিকিটে ঢাকা স্টেশনে গিয়ে নামে Ñ তাহলে সে দুর্নীতি দমন করবে কোন দুদক?

রেলের ইঞ্জিন ক্রয়ে যে দুর্নীতি হয়েছে, সেটি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি আর যাত্রীটি যে টিকিটবিহীন ভ্রমণ করেছে, সেটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক দুর্নীতি। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, টিকিট না কাটার মতো দুর্নীতি করার সাহস যাত্রীটি কোথায় পেল? কে তাকে এ ধরনের দুর্নীতিতে জড়াতে প্রলুব্ধ করলো?

ব্যক্তি দুর্নীতিগ্রস্ত হয় প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির দুর্বলতার সুযোগে। যাত্রীটি টিকিট না কেটে ভ্রমণ করার দুঃসাহস পেয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ডালপালা বিস্তারের কারণেই। প্রতিষ্ঠানটির টপ লেভেল যদি ইঞ্জিন ক্রয়ে দুর্নীতির আশ্রয় না নিত, তাহলে তাদের নৈতিকতাবোধ থাকতো প্রবল। সেই বোধে বলীয়ান হয়ে তারা মিড লেভেলকে দুর্নীতিগ্রস্ত হতে বাধা দিতে পারত। টপ ও মিড লেভেল দুর্নীতিগ্রস্ত না হলে বটম ও ফিল্ড লেভেলের দুর্নীতি করার কোনো সুযোগই থাকে না। কিন্তু যাত্রীটিকে টিকিট না কাটতে প্রলুব্ধ করেছে এই বটম ও ফিল্ড লেভেলই। টিটিসি (ট্রেন টিকিট কালেক্টর) যাত্রীটির কাছ থেকে ১০-২০ টাকা নিয়ে তাকে টিকিট না কাটার মতো অপরাধ থেকে রেহাই দিয়েছে।

এখন প্রশ্ন আসে, টিটিসি যাত্রীর কাছ থেকে নগদ টাকা নেয়ার মতো দুর্নীতি করার সাহস কোথায় পেল। এই সাহস সে পেয়েছে তার ঊর্ধ্বতন অর্থাৎ মিড লেভেলের কাছ থেকে। সে দেখেছে, তার ঊর্ধ্বতন কত সুন্দর পন্থায়ই না যাত্রীর কাছে টিকিট বিক্রি না করে কমিশনের বিনিময়ে কালোবাজারির কাছে সে টিকিট বিক্রি করে দেয়। এই পন্থায় মিড লেভেল বস যদি টুপাইস কামাতে পারে, তাহলে টিটিসি তো আর ফেরেশতা নয় যে, সে নগদ টাকার দিকে চোখ বাড়াবে না।

ফিল্ড লেভেল মিড লেভেল থেকে শিখে, মিড লেভেল টপ লেভেলের কার্যকলাপ দেখে দুর্নীতিমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যাত্রীটি যে টিকিট কাটেনি, তার সঙ্গে টিটিসিকে ১০ টাকার সুবিধা দানের পাশাপাশি টিটিসির টপমোস্ট বসদের ইঞ্জিন ক্রয়ে দুর্নীতির বিষয়টিও জড়িত।

কেন যাত্রীটি টিকিট না কেটে ভ্রমণ করলো, সরকার ও দুদকের পক্ষে তার বিচার করা সম্ভব নয়। কিন্তু উভয়ের পক্ষেই ইঞ্জিন ক্রয়ে দুর্নীতির বিচার সম্ভব। নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায়, যেকোনো প্রতিষ্ঠানে বড় লেভেলের বড় দুর্নীতি রোধ করা গেলে মাঝারি ও ছোটো লেভেলের দুর্নীতি এমনি এমনিই কমে যাবে।

সে জন্য সরকার ও দুদকের উচিত মিড ও বটম লেভেলকে নিয়ে কচলাকচলি না করে টপ লেভেলকে দুর্নীতিমুক্ত করা। টপ লেভেল দুর্নীতিমুক্ত থাকলে প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিমুক্ত থাকবে। প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিমুক্ত থাকলে ব্যক্তি ব্যক্তিকেন্দ্রিক দুর্নীতি করা থেকে বিরত থাকবে।


দুদকের সক্ষমতা

দুদকের বিরুদ্ধে অপবাদ হলো সে নখদন্তহীন বাঘ। অনেকে তাদের ‘ঢাল নেই, তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার’ও বলে থাকেন। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির সুযোগে সমাজের সর্বস্তরে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে যে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে, তা রোধ করা মোটেও দুদকের কাজ নয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ব্যক্তিকেন্দ্রিক দুর্নীতির প্রতিই যেন দুদকের প্রবল ঝোঁক। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি রোধে তাদের মধ্যে তেমন সক্রিয়তা দেখা যায় না। আজ পর্যন্ত দুদক যে তৎপরতা দেখিয়েছে, তার প্রায় সবগুলোই ব্যক্তিকেন্দ্রিক দুর্নীতি সংক্রান্ত। দুদকের কার্যক্রমে মনে হয়, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি রোধের কাজটি তাদের নয়, তাদের কাজ ব্যক্তিকেন্দ্রিক। হাইকোর্টও দুদকের বিষয়ে এমন মন্তব্য করে বলেছে, শিক্ষা ডিপার্টমেন্টে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি বন্ধ না করে দুদক প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের হাজিরা খাতা চেক করতে নেমেছে; যা তাদের কাজ নয়।

দুদক প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক দুর্নীতি জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। দুর্নীতি যেন পেয়ে বসেছে সবাইকে। যেকোনো কাজে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া যেন মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুর্নীতির সম্মিলিত রূপের কারণে দেশ এক পা এগোচ্ছে তো দুই পা পিছিয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতি এভাবে সংক্রমিত হতো না, দুর্নীতবিরোধী একমাত্র সংস্থাটি যদি নখদন্তওয়ালা বাঘে পরিণত হতো, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে থাকত।


চাই অ্যান্টি করাপশন মন্ত্রণালয়

দুর্নীতি রোধে যে একমাত্র সংস্থা দুদক আছে, তারা সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারেনি। লোকবলের সংকট, যথাযথ আইনের অনুপস্থিতি, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা, সদিচ্ছা ইত্যাদি কারণে দুদক এক দশক আগে যেখানে ছিল, এখনও সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। এই সংস্থার কার্যক্রমের ওপর ভর করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করা যায়, তবে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

এ অবস্থায় অ্যান্টি করাপশন মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। একজন মন্ত্রী এ মন্ত্রণালয়ের প্রধান হবেন না। অ্যান্টি করাপশন মন্ত্রণালয়ের প্রধান হবেন একজন ন্যায়পাল। তার পদটি হবে সাংবিধানিক, ফলে তিনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হবেন না। সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যেমন সব মন্ত্রণালয়ের লোকবলের সংস্থান করে, তেমনি অ্যান্টি করাপশন মন্ত্রণালয় অন্য সব মন্ত্রণালয়ের কাজ ও কাজ করতে গিয়ে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়ার হিসাব সংরক্ষণ করবে এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারকে পরামর্শ দেবে। সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের শাখা যেমন তৃণমূল অর্থাৎ উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত তেমনি সেখানেও থাকবে উপজেলা অ্যান্টি করাপশন কর্মকর্তার কার্যালয়।

দুদকের যে লোকবল এবং দুর্নীতির যে পরিমাণ, তাতে দুদক দিয়ে দুর্নীতির সবটা দূর করা সম্ভব নয়। দুদকের কাজ শহরকেন্দ্রিক, আরো নির্দিষ্ট করে বললে রাজধানীকেন্দ্রিক। অথচ দুর্নীতি তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। সেই তৃণমূলের দুর্নীতি রোধ করতে হলে হয় দুদককে রাজধানী পেরিয়ে তৃণমূলে যেতে হবে অথবা তৃণমূলের দুর্নীতি রোধ হয় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সে ব্যবস্থারই সর্বোচ্চ মাধ্যম হলো অ্যান্টি করাপশন মন্ত্রণালয় গঠন ও ন্যায়পাল নিয়োগ।


আশা আছে এখনও

দুর্নীতিতে কী বাংলাদেশ আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে গেছে Ñ এ প্রশ্ন অনেকের। উত্তরে বলা যায়, দেশে সব সেক্টরে দুর্নীতি কমবেশি থাবা প্রসারিত করেছে, তবে বিস্তৃত হতে পারেনি। সর্বগ্রাসী দুর্নীতিতে দেশ নিমজ্জিত হলে এলডিসিভুক্ত (লো ডেভলপিং কান্ট্রিজ) দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় প্রবেশ করতে পারতো না। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বৃত্ত ভেঙে ৭.৪২-এ উন্নীত হতো না, রিজার্ভ ৪১ বিলিয়ন ডলারের ঘর স্পর্শ করতো না। পদ্মাসেতু দৃশ্যমান হতো না, বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া যেত না, ১২ কোটি মানুষের হাতে মোবাইল ফোন উঠত না। মাথাপিছু আয় ১,৭০০ ডলারে উন্নীত হতো না, শিক্ষিতের হার ৬৫ শতাংশের ঊর্ধ্বে উঠত না, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট পাঠানো যেত না, পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা ভাবা যেত না।

সুতরাং বলা যায়, দুর্নীতিতে দেশ আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে যায়নি। দুর্নীতির ব্যাপকতা এখন যে অবস্থায় আছে, সেখান থেকে অবশ্যই ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব। এর জন্য দরকার সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক কঠোরতার। সুখের বিষয় হলো, এই দুটি উপাদানই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে আছে। আর সেজন্যই আশা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। বাংলাদেশ একটি দুর্নীতিমুক্ত উন্নত দেশ হবে Ñ এমন আশা বাংলাদেশের এখনও আছে।


শেষ কথা

২০১৯ সালে এসে বাংলাদেশ আর আশি/ নব্বই দশকের ভঙ্গুর পায়ে দাঁড়িয়ে নেই। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন স্বাধীন সবল পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বের কারণে দেশের সর্বত্রই উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। মানুষের জীবনযাত্রার যেমন উন্নয়ন ঘটেছে, জীবনযাত্রার অনুঘটকগুলোরও বিষ্ময়কর উন্নতি হয়েছে। মানুষ স্বকর্মসংস্থানে উদ্বুদ্ধ হয়েছে এবং সরকার তাতে যথোপযুক্ত সাড়া দিয়েছে। যুব উন্নয়ন অধিদফতর থেকে প্রশিক্ষণ ও ঋণ গ্রহণ করে লাখ লাখ তরুণ নিজের এবং আরো কয়েকজনের বেকারত্ব ঘুচিয়েছে। সবাই কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছে। আপাতদৃষ্টিতে যে তরুণকে দেখে বেকার মনে হয়, সে-ও তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন কাজে (ফ্রি ল্যান্সিং) নিজেকে জড়িত করে দিনশেষে ৫০০-৭০০ টাকা উপার্জন করছে।

সর্বগ্রাসী দুর্নীতিতে দেশ নিমজ্জিত হলে এসব অর্জন সম্ভব হতো না। মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, সংস্থা ইত্যাদিতে এখনো সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন বলেই সবকিছু গড়বড় হয়ে যায়নি। অস্বীকার করার জো নেই, সৎ ও নীতি নৈতিকতাবোধে সমৃদ্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা দ্রুত কমছে, এর বিপরীতে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা দ্রুততম হারে বাড়ছে।

এমন এক অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। তিনি নিশ্চয়তা দিয়ে বলেছেন, দুর্নীতি উৎখাত করবেনই। এই দুর্নীতি উৎখাত করতে গিয়ে তিনি যে সামান্যতম সহিষ্ণুতা দেখাবেন না, তার প্রমাণ আগেও বহুবার রেখেছেন, এবারও রাখবেন।

প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি যে বা যারা করেন, তারা প্রধানমন্ত্রীর এই মনোভাবটি বুঝতে পারলে ভালো করবেন। যারা দুর্নীতিবাজ, তাদের মনে রাখা দরকার, আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারকে দুর্নীতিগ্রস্ত বানাতে চেয়েছিল। শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার দুর্নীতি করেনি বলেই শত চেষ্টার পরও আন্তর্জাতিক মহলটিকে হতাশ হতে হয়েছিল। সেই দুর্নীতিহীন প্রধানমন্ত্রী আমলাতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির কারণে নিজের ও তাঁর সরকারের মান-সম্মান জলাঞ্জলি দিতে পারেন না। বঙ্গবন্ধুর বাঁধানো ছবি মাথার উপরে ঝুলিয়ে সমানে দুর্নীতি করে যাবেন আর সরকারপ্রধান চেয়ে চেয়ে দেখবেন Ñ এমন বোকা শেখ হাসিনা নন।

সরকার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূলে সফল শেখ হাসিনা এবার মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির মতো সময়োপযোগী সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং দুদক ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে অধিকতর সক্রিয় করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ের মাদক ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযানসমূহ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও দুদক দলমত নির্বিশেষে তাদের কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে Ñ কাউকেই কোনোরূপ ছাড় দেয়া হচ্ছে না। বরং এক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের নীতি ও আদর্শ অনুযায়ী বেশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে দুদক ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর।

দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখার হুঁশিয়ারি দিয়ে সম্প্রতি দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, দুর্নীতিবাজদের লোভের জিভ কেটে ফেলা হবে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ইকবাল মাহমুদ বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধে দলমত নির্বিশেষে কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।

এদিকে মাদকবিরোধী অভিযান সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব মো. জামাল উদ্দীন আহমেদ স্বদেশ খবর প্রতিবেদককে বলেন, দেশের বর্তমান তরুণপ্রজন্ম ও দেশের মানুষকে মাদকের ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির আলোকে সারাদেশে মাদকবিরোধী অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের অনমনীয় কঠোর অবস্থানের কারণে দেশের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক মাদককারবারিও আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে। কারণ মাদককারবারিদের কাছে ইতোমধ্যে কঠোর বার্তা পৌঁছে গেছে যে, দলমত নির্বিশেষে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা এবার দুর্নীতি ও মাদকের ক্ষেত্রেও কাউকেই ছাড় দেবেন না। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় অভাবনীয় উন্নয়ন হওয়ায় এদেশের মানুষের এখন বদ্ধমূল ধারণা যে, একমাত্র শেখ হাসিনার পক্ষেই বাংলাদেশ থেকে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের ন্যায় মাদক এবং দুর্নীতিও নির্মূল সম্ভব। আর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেখ হাসিনা ও তাঁর নেতৃত্বাধীন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সে পথেই এগোচ্ছে।

Post a Comment

0 Comments