তারেক রহমানের পাসপোর্ট ও নাগরিকত্ব নিয়ে সারাদেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। বিএনপি বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে এবং এর প্রমাণ পাওয়া যায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও দুটি জাতীয় দৈনিকের বিরুদ্ধে উকিল নোটিশ প্রেরণের মাধ্যমে। বিএনপির এ প্রতিক্রিয়া খুবই স্বাভাবিক। কারণ এর ফলে তারেক রহমানের দেশপ্রেম যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, তেমনি নাগরিকত্ব না থাকলে দলের নেতৃত্ব থেকেও সরে আসতে হবে। আবার দলের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করলে বিএনপির ভাঙন অনিবার্য হয়ে দাঁড়াবে। তাই সরকার ও বিএনপি উভয়ের জন্যই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।
তারেক রহমানের পাসপোর্ট বিতর্কের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ব্রিটেন ও বাংলাদেশের নাগরিকত্ব সংশ্লিষ্ট আইনগত ব্যাখ্যা। তবে পাসপোর্টের বিষয়টিও সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। কারণ এখানে একাধিক পাসপোর্ট গ্রহণের ফলে ফৌজদারি অপরাধ সংগঠনের ক্ষেত্র রয়েছে।
তারেক রহমানের আইনজীবী কর্তৃক আদালতে উত্থাপিত দলিলে দেখা যায়, তারেক রহমান ২০০৫ সালে ণ০০৮৫৪৮৩ নম্বর পাসপোর্ট গ্রহণ করেছিলেন যার মেয়াদ ছিল ২০১০ সাল পর্যন্ত। এ পাসপোর্টের মাধ্যমে ২০০৫ সালের ৫ মে তারেক রহমান যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করেছিলেন। কিন্তু ২০০৮ সালে আমেরিকার ভিসার জন্য আবেদন করলে তার বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদ ও অর্থপাচারের সুস্পষ্ট অভিযোগ থাকায় ওসসরমৎধঃরড়হ ধহফ ঘধঃরড়হধষরঃু অপঃ-এর ২১২(ভ) ধারা এবং চৎবংরফবহঃরধষ চৎড়পষধসধঃরড়হ ৭৭৫০ অনুসারে তারেক রহমানের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয় এবং ভিসা নিষিদ্ধের সিল দেয়া হয়। এ তথ্যটি উইকিলিকসে মার্কিন নথির সূত্র উল্লেখ করে প্রকাশিত হয়েছিল। নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে তারেক রহমান ২০০৮ সালে নতুন একটি পাসপোর্ট গ্রহণ করেন। উল্লিখিত পাসপোর্টটি ২০১০ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিবের নির্দেশনায় নবায়ন করা হয়। ২০০৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বরে ইস্যুকৃত ঈ ০৯৭৪৪৯৬ নম্বর পাসপোর্টটি দুই বছরের জন্য জরুরি ভিত্তিতে প্রদান করা হয়েছিল। ১১ সেপ্টেম্বর লন্ডন গমনের পর ২০০৮ সালের ৪ ডিসেম্বরে পাসপোর্টের মেয়াদ ২০১৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করে পাসপোর্টটি রেগুলারাইজড করা হয়। এ পাসপোর্টে দেখা যায়, তিনি ২০০৪ সালে গৃহীত ড ০৭৫৭৪২৪ নম্বর পাসপোর্টটি হারিয়ে গিয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। সেটি ইস্যু হয়েছিল ৭ অক্টোবর ২০০৪ এবং মেয়াদ ছিল ৩ জুন ২০১০ পর্যন্ত।
প্রাপ্ত তথ্যাবলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তারেক রহমানের কাছে দুটি পাসপোর্ট রয়েছে এবং দুটির মেয়াদ শেষ হয় যথাক্রমে ২০১৩ ও ২০১৫ সালে, যা আইনত শাস্তিযোগ্য অপরাধ। একাধিক পাসপোর্ট থাকা আইনত শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পর্যবেক্ষণে মনে হচ্ছে এ নিয়ে সরকার আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
তারেক রহমানের ব্রিটেনে অবস্থানের ক্ষেত্রে পাসপোর্ট তেমন গুরুত্ব বহন করে না। ২০০৮ সালে প্রবেশের পর ২০১৩ সালে তারেক রহমানকে যুক্তরাজ্যের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ভিসা অথরিটি টকঠ-এর কাছে নিজের অবস্থান তুলে ধরতে হয়েছিল। ১২ মাস ও ৫ বছর মেয়াদ ভিত্তিক ভিসার সময়সীমার বিষয়টি বিবেচনা করলে ধারণা করা যায় ২০১৮ সালেই তাকে এ বিষয়ের নিষ্পত্তি করতে হবে। বর্তমানে তারেক রহমান স্টেটলেস হিসেবে জেনেভা কনভেনশন পাসপোর্টধারী, তিনি বসবাস করছেন প্রোটেকটেড রেসিডেনশিয়াল স্ট্যাটাসে। কেউ গুগল ম্যাপে গেলে দেখতে পাবেন তারেক রহমানের লন্ডনের ঠিকানাটির স্ট্রিট ভিউ নেই। এটি প্রোটেকটেড স্ট্যাটাসের কারণে হয়। তারেক রহমান এ ক্যাটাগরিতে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন। ব্রিটেনে বসবাসের জন্য তাকে একটি নির্দিষ্ট ক্যাটাগরি বেছে নিয়েই সেটেলমেন্ট করতে হবে।
যুক্তরাজ্যে ৬টি ক্যাটাগরিতে বসবাসের সুযোগ রয়েছে; যার দুটি তারেক রহমানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। একটি ক্যাটাগরি হচ্ছে প্রোটেকটেড বা স্টেটলেস ক্যাটাগরি। এ শ্রেণিভুক্তরা নির্দিষ্ট কোনো দেশের নাগরিক হিসেবে বিবেচ্য না হওয়ায় ব্রিটিশ সরকারের সুরক্ষা পেয়ে থাকে। এ শ্রেণিতে নাগরিকত্ব অর্জনকারীদের ব্রিটেন আইনগত ও কূটনৈতিক সহায়তা দিয়ে থাকে।
ব্রিটিশ নাগরিকত্ব অর্জনে দ্বিতীয় ক্যাটাগরি হচ্ছে কমনওয়েলথভুক্ত দেশসমূহের জন্য নাগরিকত্ব অর্জনের সুযোগ। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাগরিক এই ক্যাটাগরিতে ডুয়েল সিটিজেন হিসেবে যুক্তরাজ্যে বসবাস করে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য সরকারের কাছ থেকে আইনগত সহযোগিতা পাওয়ার ক্ষেত্র সীমিত হয়।
ব্রিটেনে বসবাস করে কেউ যদি যুক্তরাজ্য সরকারের কূটনৈতিক সহযোগিতা ও সুরক্ষা চায় তা হলে তাকে প্রোটেকটেড ক্যাটাগরি বেছে নিতে হবে। ডুয়েল সিটিজেনরা ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের আইনগত বা কূটনৈতিক সহায়তা পান না। যেমন মূল দেশের আদালত যদি সংশ্লিষ্টের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চায় তা হলে ব্রিটিশ সরকার নিরপেক্ষ থাকবে। বাংলাদেশ চাইলে তাকে ফেরত পাঠানো হতে পারে। তবে বন্দি বিনিময়ের ক্ষেত্রে দ-প্রাপ্ত ব্যক্তিকে ফাঁসি দেয়া যাবে নাÑ এই মর্মে যুক্তরাজ্য সরকারকে নিশ্চয়তা দিতে হয়।
অন্যদিকে এককভাবে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব গ্রহণ করলে তারেক রহমান ব্রিটেনের নাগরিক হিসেবে, বিশেষত প্রোটেকটেড সিটিজেন হিসেবে যুক্তরাজ্য সরকারের পূর্ণ আইনগত ও কূটনৈতিক সহায়তা ভোগ করবেন। বাংলাদেশ সরকার চাইলেও তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে তা কার্যকর করতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকে যুক্তরাজ্যের আদালতে আইনজীবী নিয়োগ করে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে মামলা চালাতে হবে। অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে কোনো দেশের সরকারের পক্ষে মামলা পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। এর অন্যতম উদাহরণ ভারতে গুলশান কুমার হত্যাকা-ে অভিযুক্ত সংগীত পরিচালক নাদিম সাইফি। ভারত সরকার অনেক চেষ্টা করেও তাকে আনতে পারেনি।
তারেক রহমানকে যুক্তরাজ্যে বসবাস করতে হলে যেকোনো একটি পথ বেছে নিতে হয়েছে বা হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে তিনি প্রোটেকটেড ক্যাটাগরিই বেছে নেবেন কিংবা ইতোমধ্যে হয়ত এই ক্যাটাগরি বেছে নিয়েছেন। কিন্তু এ ক্যাটাগরিতে যোগ্য হতে হলে তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বর্জন করতে হবে। ডুয়েল সিটিজেনশিপ গ্রহণের সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশের আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে তারেক রহমান কখনই ডুয়েল সিটিজেন হওয়ার ঝুঁকি নেবেন না। যুক্তরাজ্যের হোম অফিসের মাধ্যমে বাংলাদেশ দূতাবাসে পাসপোর্ট প্রেরণ করেছেন মূলত বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বর্জনের প্রক্রিয়া হিসেবে। তারেক রহমানের নাগরিকত্ব ইস্যু যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ ঘটাবে তা সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে। তাই এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে কথা বলতে হবে; কোনো অনুমান নির্ভর কথা বলা যাবে না।
0 Comments