নিজস্ব প্রতিবেদক
শেষ পর্যন্ত ব্যাংকঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই সুদহার হবে ৯ শতাংশ। নতুন বছরের প্রথম দিন থেকে উৎপাদন খাতে অর্থাৎ শিল্প খাতে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ করতে হবে ব্যাংকগুলোকে।
২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ১ জানুয়ারি থেকে নতুন সুদহার কার্যকরের নির্দেশনা দিয়ে সার্কুলার জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকভেদে উৎপাদন খাতে সুদহার ১১ থেকে ১৪ শতাংশ। ব্যাংকঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার কৌশল ঠিক করতে গত ১ ডিসেম্বর ডেপুটি গভর্নর এস এম মনিরুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটির সুপারিশের আলোকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বোর্ড সভায় শিল্প খাতে ৯ শতাংশ সুদহার নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। গভর্নর ফজলে কবির সভায় সভাপত্বি করেন।
এদিকে ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ব্যাংক ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট অর্থাৎ ৯ অঙ্ক কার্যকর করতে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাবে ব্যাংকগুলো। বিভিন্ন মেয়াদে যাদের কাছ থেকে আমানত নেয়া হয়েছিল তাদের সুদহার কমানো যাবে না। অর্থাৎ চুক্তি অনুযায়ী দিন শেষে তাদের সুদাসলে ফেরত দিতে হবে। কিন্তু নতুন-পুরনো মিলে ১ জানুয়ারি থেকেই উৎপাদনমুখী সব শিল্পঋণের সুদহার ৯ অঙ্কের ঘরে নামিয়ে আনতে হবে। এতে আমানতের সুদহার না কমাতে পারলেও ঋণের সুদহার কমে যাওয়ায় যে লোকসানের মুখে পড়বে ব্যাংকগুলো, তা সমন্বয় করা কঠিন হয়ে যাবে।
সংশ্লিষ্টরা আরো বলছেন, মুদ্রার চাহিদা ও জোগানের ওপর নির্ভর করে ঋণের সুদহার। বিনিয়োগ চাহিদা বেশি হলেও সে অনুযায়ী টাকার প্রবাহ কম থাকলে ঋণের সুদহার বেড়ে যাবে। আবার টাকার প্রবাহ বেশি থাকলে আর সে অনুযায়ী ঋণের চাহিদা কম থাকলে ঋণের সুদহার এমনিতেই কমে যাবে। দেড় বছর আগে ৯-৬ ঘোষণা করার পর থেকেই আমানতপ্রবাহ কমতে থাকে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো নানাভাবে আমানতের সুদহার কিছুটা কমিয়ে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হয়েছে। আমানতের সুদহার কমে যাওয়ায় সাধারণ আমানতকারীরা টাকা ব্যাংকে না রেখে বেশি মুনাফার জন্য সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন খাতে রাখতে থাকে। এতে ব্যাংকিং খাতে আমানতপ্রবাহ কমে যায়। কোনো কোনো ব্যাংকে টাকার সংকট তীব্র হওয়ায় তারা আবার সুদহার বাড়াতে থাকে। অর্থাৎ দুই-একটি ইসলামী ব্যাংক বাদে আর সব বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকই আমানতের সুদহার ৯ শতাংশের উপরে নিয়ে গেছে। কোনো কোনো ব্যাংক আমানতের সুদহার বাড়িয়ে ১০ থেকে ১১ শতাংশে উন্নীত করেছে। এমন পরিস্থিতিতে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনাকে ব্যাংকগুলোকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের জনৈক কর্মকর্তা স্বদেশ খবরকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে নতুন-পুরনো মিলে উৎপাদনমুখী শিল্প ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে, এটাই বাস্তবতা। কিন্তু নতুন ঋণের েেত্র যতটা সমস্যা দেখা না দেবে, তার চেয়ে বেশি সমস্যা দেখা দেবে পুরনো ঋণের সুদহার কমানোর েেত্র। কারণ অতীতে যাদেরকে ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল, সেটা তো অতীতের আমানতের অর্থ দিয়ে বিতরণ করা হয়েছিল। যেমন ৩ বছর আগে একজন গ্রাহকের কাছ থেকে ১০০ টাকা আমানত সংগ্রহ করা হয়েছিল। ৫ বছর পরে তাকে সুদাসলে ২০০ টাকা ফেরত দিতে হবে। ওই ১০০ টাকার মধ্যে এসএলআর ও সিআরআর সংরণ করার পর ৮১ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে বার্ষিক ১২ শতাংশ সুদে। ইতোমধ্যে ৩ বছর অতিবাহিত হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী আর ২ বছর পর আমানতকারীকে সুদে-আসলে ২০০ টাকা ফেরত দিতে হবে। কিন্তু এখন ৩ বছর আগে যাকে ১৩ শতাংশ ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী ওই ঋণের সুদহার সরাসরি ৪ শতাংশ কমিয়ে ৯ শতাংশ করতে হবে। অথচ দেখা গেছে, ব্যাংক ১০ শতাংশ সুদে আমানত গ্রহণ করেছিল। এতে শুধু গ্রাহককেই সুদ পরিশোধ করতে হবে ১ শতাংশ লোকসান দিয়ে। আর পরিচালন ব্যয় যোগ করলে আরও ৩ শতাংশ বেড়ে যাবে। অর্থাৎ ঋণগ্রহীতা ৩ শতাংশ কমাতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে সুদহারে ৪ শতাংশ লোকসান দিতে হবে। এটা যদি ১০ হাজার কোটি টাকা হয়, তাহলে ৪ শতাংশ হারে একটি ব্যাংকের সুদহারে লোকসান হবে ৪০০ কোটি টাকা। আর ২ শতাংশ হলে লোকসান হবে ২০০ কোটি টাকা। বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। এর এক-চতুর্থাংশ যদি শিল্পঋণ হয় তাহলে মোট শিল্পঋণের পরিমাণ হবে আড়াই লাখ কোটি টাকা। এ আড়াই লাখ কোটি টাকায় ব্যাংক খাতকে রাতারাতি লোকসান দিতে হবে ৪ শতাংশ হারে ১০ হাজার কোটি টাকা; আর ২ শতাংশ হারে ৫ হাজার কোটি টাকা। এত বড় লোকসানের ধকল সামলানোর সক্ষমতা বর্তমানে ব্যাংক খাতের নেই।
তারপরও সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে ব্যাংকগুলো বাধ্য। তা হলে ভবিষ্যতে ব্যাংকিং খাতের পরিস্থিতি কী হবে তা দেখার জন্য আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।
তাই সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিলে ব্যাংক খাতের প্রতি সুবিচার করা হবে না। কারণ পুরনো শিল্পঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনলে যে পরিমাণ লোকসান হবে, ব্যাংক খাত ওই লোকসানের ধকল কিভাবে কাটিয়ে উঠবে তার পথও দেখালে ব্যাংকখাতের প্রতি সুবিচার করা হবে। তাও না হলে ব্যাংকগুলোর সমস্যা দেখা দিলে পুরো অর্থনীতিতেই সমস্যা দেখা দেবে। এতে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগসমতা ভেঙে পড়বে। এতে কাক্সিক্ষত হারে জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে না। তা হলে ব্যাংকিং খাতের পরিবর্তিত নাজুক পরিস্থিতি বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারকেই সামলাতে হবে।
0 মন্তব্যসমূহ