নিজস্ব প্রতিবেদক
করোনায় অর্থনীতির ভয়াবহ ক্ষতির মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার বেড়েছে। কয়েক বছর ধরেই জিডিপির আকার ১২ থেকে ১৪ শতাংশ হারে বাড়ছে। একইভাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এরবিআর) আয়ও গড়ে ১৪ শতাংশের বেশি হারে বাড়ছে। তারপরও বিশে^র বিভিন্ন অঞ্চল, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ রাজস্ব-জিডিপির অনুপাতে সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে। বিশে^র দ্রুততম প্রবৃদ্ধি অর্জন করা দেশগুলোর একটি হওয়া সত্ত্বেও প্রশ্ন উঠেছে কর-জিডিপি অনুপাতের উন্নতি হচ্ছে না কেন?
কর বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, জিডিপির তুলনায় রাজস্ব আয় কম হওয়ার বড় কারণ হচ্ছে কর ফাঁকি। তারা বলছেন, জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ যাদের আয় করযোগ্য, তারা করের আওতার বাইরে রয়েছেন। আবার যারা কর দিচ্ছেন, তারাও প্রকৃত আয় গোপন করে কর ফাঁকি দিচ্ছেন। বেসরকারি খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান বিক্রি ও মুনাফা কমিয়ে দেখাচ্ছে। এ ছাড়া বেশ কিছু খাত ও প্রতিষ্ঠান কর অবকাশের সুবিধায় রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। আবার রাজস্ব আহরণে এনবিআরের কর্মকর্তাদের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে। আবার সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ভ্যাট আদায় করলেও তা দেখাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন তারা। জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব কম আহরণের এগুলোই বড় কারণ।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের জিডিপির আকারের তুলনায় রাজস্ব আয়ের অনুপাত সবচেয়ে কম। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশ সর্বনিম্নে। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে গড়ে জিডিপির ৯ দশমিক ৯ শতাংশ ছিল মোট রাজস্ব আহরণ। এ সময়ে ভারতে ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ, নেপালে ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৪ দশমিক ৭ ও শ্রীলঙ্কায় ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল কর-জিডিপির গড় অনুপাত। আর উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশে এই অনুপাত ছিল গড়ে ২৫ দশমিক ৬ শতাংশ। একই সময়ে উন্নত দেশগুলোতে গড়ে ৩৫ দশমিক ৯ শতাংশ ছিল কর-জিডিপির অনুপাত।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ এ বিষয়ে স্বদেশ খবরকে জানান, আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির যারা ভাগীদার তারা কর দেয় না বা দিলেও কম দেয়। এখানে বড় ধরনের মিসম্যাসের কারণে জিডিপির ২-৩ শতাংশ হারিয়ে যাচ্ছে।
এনবিআরের রাজস্ব আয় আসে মূলত বেসরকারি খাত থেকেই। কিন্তু বেসরকারি খাতও টার্নওভার ও মুনাফা সঠিকভাবে দেখাচ্ছে না বলে মনে করছেন আবদুল মজিদ। অনেক প্রতিষ্ঠান আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমেও কর ফাঁকি দিচ্ছে। সঠিক কর আদায়ের জন্য এনবিআরকে কড়া ইনফোর্সমেন্টে যেতে হবে বলে পরামর্শ দেন তিনি। একই সঙ্গে এনবিআরকে দক্ষ জনবল বাড়াতে হবে। সমঝোতার মাধ্যমে কর ফাঁকিতে যদি এনবিআরের কেউ জড়িত থাকে, তার বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কর বিষয়ে অনেক কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রচুর মামলা রয়েছে। এগুলো বিশেষ ব্যবস্থায় দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগও নিতে হবে।
চলতি অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) থাকা প্রকল্পগুলোতে ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও সংশোধিত বাজেটে তা ১ লাখ ৯২ হাজার ৯২১ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। আর ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এডিপির আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। দেশে চলমান মেগা প্রকল্পসহ বেশির ভাগ উন্নয়ন প্রকল্প জিডিপিতে অবদান রাখলেও এগুলোর বেশির ভাগকেই করের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে।
২০১৯-২০ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে জিডিপির আকার ধরা হয়েছে ২৮ লাখ ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপির আকার বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ বাড়িয়ে ৩১ লাখ ৭১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতি বছর গড়ে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ হারে চলতি মূল্যে জিডিপির আকার বাড়ে। জিডিপির যে আকার ধরা হয় তা থেকে মূল্যস্ফীতি বাদ দিয়ে প্রবৃদ্ধি হিসাব করা হয়।
চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ৬৪ হাজার ১৪০ কোটি টাকা, যা সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার ৪৭ দশমিক ২ শতাংশ। মোট রাজস্ব আহরণের ৮৩ দশমিক ১ শতাংশ হচ্ছে এনবিআর কর। করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে আয় ও মুনাফা কর ছাড়া এনবিআর কর রাজস্বের অন্য সব খাতে ঋণাত্মক প্রবদ্ধি হয়েছে।
জানা গেছে, করসংক্রান্ত মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণেও এনবিআরের দাবি করা বিপুল পরিমাণের অর্থ আইনি বেড়াজালে আটকে রয়েছে। করসংক্রান্ত বিভিন্ন কোম্পানি, ব্যক্তি ও এনবিআরের বিরুদ্ধে প্রায় ৫০ হাজার মামলা রয়েছে, যেগুলোতে ৪০ থেকে ৪২ হাজার কোটি টাকা আটকে আছে। বছরের পর বছর ধরে দেশের বিভিন্ন আদালতে করসংক্রান্ত মামলাগুলো ঝুলে আছে।
দেশের রাজস্ব আহরণ কৌশলে দুর্বলতার বিষয়টি সরকারও স্বীকার করে। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এক দশকে স্থিতিশীল উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পরও রাজস্ব আহরণ কৌশলে দুর্বলতা থাকায় রাজস্ব প্রশাসনে উল্লেখযোগ্য সংস্কারের প্রয়োজন। এ জন্য কর ভিত্তির সম্প্রসারণ, কর রেয়াতের সংখ্যা কমানো, কর হার যৌক্তিকীকরণের পাশাপাশি উন্নত প্রতিপালন ও পরিষেবার জন্য রাজস্ব প্রশাসন শক্তিশালীকরণের বিকল্প নেই।
রাজস্ব খাতের সংস্কারের অংশ হিসেবে গত বছরের ১ জুলাই থেকে মূসক এবং সম্পূরক শুল্ক আইন ২০১২ কার্যকর হয়েছে। আইনটির বাস্তবায়ন সহজ করতে সংশোধনী আনা হয়েছে। আইনটি বাস্তবায়নের ফলে মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক সংগ্রহের ক্ষেত্রে আগামীতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির আশা করছে এনবিআর। মূল্য সংযোজন কর ফাঁকি রোধ ও এর সংগ্রহ বাড়াতে ৫০ লাখ টাকা বা বন্ডে বেশি টার্নওভার থাকা প্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) বসাতে যাচ্ছে। কর ফাঁকি রোধে বার্ষিক টার্নওভার ৫ কোটি বা তার বেশি মূসক নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানে এনবিআর নির্দেশিত মূসক সফটওয়্যার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কর অবকাশ ও হ্রাসকৃত হারে কর দেয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমিয়ে আনা হচ্ছে। শুল্ক প্রক্রিয়াকে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সহজ করতে নতুন শুল্ক আইন পাস হতে যাচ্ছে। করদাতার সংখ্যা ২৩ লাখ থেকে ১ কোটিতে উন্নীত করার উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর।
0 Comments