যে কারণে রেমিট্যান্স বাড়ছে

 নিজস্ব প্রতিবেদক

বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য কর্মী যাওয়ার হার কমলেও তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়ছে। এটা হয়েছে মূলত ২টি কারণে। বাংলাদেশ এখন আগের চেয়ে বেশি হারে অভিজ্ঞ শ্রমিক পাঠানোর সক্ষমতা অর্জন করেছে। ফলে প্রবাসী শ্রমিকরা বেশি বেতন পাচ্ছে এবং বেশি রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছে। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশে শ্রমিকদের বেতনকাঠামোও গত ২-৩ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। বাংলাদেশি একজন অনভিজ্ঞ শ্রমিক আগে যেখানে ১৫ হাজার টাকা মজুরি পেত, এখন সেখানে ৩০ হাজার টাকা পাচ্ছে।


২০১৯ সালে ১৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে প্রবাসীরা। চলতি অর্থবছরের ৬ মাসে (২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত) দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৯১৯ কোটি ৭৭ লাখ ডলার (৯.৯৪ বিলিয়ন)। সরকারের আশা, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ২১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

এই মুহূর্তে অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে স্বস্তিদায়ক সূচক রেমিট্যান্স। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সেই এখন সচল রেখেছে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা। আর রেমিট্যান্স প্রবাহের এই ইতিবাচক ধারায় রপ্তানি আয়ে বড় ধাক্কার পরও বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ চাপের মধ্যে রয়েছে। অর্থনীতির অধিকাংশ সূচক কিছুটা নিম্নমুখী। এই ‘বৈরী হাওয়ার’ মধ্যে একমাত্র রেমিট্যান্সই আশার আলো ছড়াচ্ছে। ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা, জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধি এবং বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।

রেমিট্যান্স সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ডিসেম্বর মাসের ২৬ দিনে ১৪৮ কোটি ৩৭ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এ নিয়ে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৫ মাস ২৬ দিনে (১ জুলাই থেকে ২৬ ডিসেম্বর) রেমিট্যান্সের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯১৯ কোটি ৭৭ লাখ (৯.৯৪ বিলিয়ন) ডলার।

এদিকে এর আগের মাস গত নভেম্বরে ১৫৫ কোটি ৫২ লাখ (১.৫৫ বিলিয়ন) ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা গত বছরের নভেম্বরের চেয়ে ৩১ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি। অক্টোবর মাসে ১৬৪ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। যা ছিল এক মাসের হিসাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স। তার আগে সেপ্টেম্বরে পাঠিয়েছিলেন ১৪৬ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। আগস্টে আসে ১৪৪ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে এসেছিল ১৫৯ কোটি ৭৭ লাখ ডলার।

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহে সুখবর দিয়ে শেষ হয় ২০১৮-১৯ অর্থবছর। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুন মাসে দেশে রেমিট্যান্স আসে ১৩৬ কোটি ৮২ লাখ ডলার। মে মাসে আসে ১৭৪ কোটি ৮১ লাখ ডলার। এপ্রিল মাসে আসে ১৪৩ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। মার্চ মাসে আসে ১৪৫ কোটি ৮৬ লাখ ডলার। ফেব্রুয়ারি মাসে আসে ১৩১ কোটি ৭৭ লাখ ডলার এবং জানুয়ারি মাসে আসে ১৫৯ কোটি ৭২ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে ২০১৯ সালে প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ১ হাজার ৮১২ কোটি ডলার (১৮.১২ বিলিয়ন ডলার)।

জানা যায়, বর্তমানে ১ কোটির বেশি বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। জিডিপিতে তাদের পাঠানো অর্থের অবদান ১২ শতাংশের মতো। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস উপলে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বলেন, ‘চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ২১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। গত অর্থবছরে সাড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। এবার প্রথম ৫ মাসে সাড়ে ২২ শতাংশ বেশি এসেছে। এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে প্রত্যাশা করছি। আর সেেেত্র অর্থবছর শেষে রেমিট্যান্স ২১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।’

জানা যায়, গত কয়েক বছর ধরে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান কৃত্রিমভাবে প্রায় একই হারে ধরে রাখা হচ্ছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে চীন ঘোষণা দিয়ে তাদের মুদ্রা ইউয়ানের অবমূল্যায়ন করে। এরপর টিকে থাকতে প্রতিযোগী দেশগুলোও নিজ নিজ মুদ্রার অবমূল্যায়ন শুরু করে। কিন্তু টাকার অবমূল্যায়ন না করে বিকল্প হিসেবে প্রবাসী আয়ে প্রণোদনা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ সরকার। এর প্রভাবে ২০১৯ সালে এ পর্যন্ত প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ১ হাজার ৮১২ কোটি ডলার (১৮.১২ বিলিয়ন ডলার)। বর্তমানে রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। প্রবাসীরা এখন ১০০ টাকা দেশে পাঠালে যার নামে টাকা পাঠাচ্ছেন তিনি ওই ১০০ টাকার সঙ্গে ২ টাকা যোগ করে ১০২ টাকা তুলতে পারছেন। এরই ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রবৃদ্ধিতে।

এদিকে রেমিট্যান্স বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভও সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে। গত ৩০ ডিসেম্বর দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে রিজার্ভ ৩২ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। এশিয়ান কিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ৯৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৩১ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। গত এক মাসে তা বেড়ে আবার আগের অবস্থানে উঠেছে।

২০১৯ সালে নভেম্বর পর্যন্ত ৬ লাখ ৪ হাজার ৬০ জন বাংলাদেশি কর্মী কাজের জন্য বিভিন্ন দেশে গেছেন। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে ৭ লাখ ৩৪ হাজার ১৮১ কর্মী বিদেশ যান। নারী কর্মীদের ওপর নির্যাতন ও অনেক নারী কর্মীর দেশে ফিরে আসার পরও চলতি বছর বিদেশে নারী কর্মী যাওয়ার প্রবাহ কমেনি, বরং ৪ দশমিক ৫২ শতাংশ বাড়ছে। এই বছর এখন পর্যন্ত ৩ হাজারের মতো নারী কর্মী সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে এসেছেন। চলতি বছর সবচেয়ে বেশি কর্মী গেছেন সৌদি আরবে। মোট অভিবাসী কর্মীর প্রায় ৬০ শতাংশই গেছে দেশটিতে। এরপর গেছে ওমানে।

ল্যণীয় বিষয় হলো ২০১৮ সালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চসংখ্যক কর্মী গিয়েছিল মালয়েশিয়াতে। ওই বছর দেশটিতে প্রায় ১ লাখ ৭৬ হাজার কর্মী গিয়েছিল। কিন্তু সিন্ডিকেট করে বেশি খরচে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর অভিযোগে দেশটি কর্মী নেয়া স্থগিত রেখেছে। এ বছর কর্মী যাওয়ার সংখ্যা কমার এটিও অন্যতম কারণ।

Post a Comment

0 Comments