ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট), গাজীপুর

 ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট), গাজীপুর বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রধান প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এটি গাজীপুরে অবস্থিত এবং শুধুমাত্র ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। চলুন, ডুয়েট সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক:


প্রতিষ্ঠার ইতিহাস:

ডুয়েটের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। ১৯৮০ সালে ‘কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং, ঢাকা’ নামে এর যাত্রা শুরু হয়, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অনুষদের অধীনে ছিল। ১৯৮১ সালে এর নাম পরিবর্তন করে ‘ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (ডেক)’ রাখা হয়। এরপর ১৯৮৬ সালে এটিকে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (বিআইটি), ঢাকা’ হিসেবে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করা হয়। অবশেষে, ২০০৩ সালে এটিকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দেওয়া হয় এবং ‘ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট)’ নামে পরিচিতি লাভ করে।

ক্যাম্পাস ও পরিবেশ:

ডুয়েটের প্রধান ক্যাম্পাসটি গাজীপুরের ঢাকা-জয়দেবপুর-শিমুলতলী রোডের পাশে ২০.২৯ একর জমির উপর অবস্থিত। এছাড়াও, ডুয়েটের একটি নতুন ক্যাম্পাস গাজীপুরের মাঝিরখোলা রোডে তৈরি করা হয়েছে, যা ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করেছে। ক্যাম্পাসের মনোরম পরিবেশ শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য অনুকূল।

শিক্ষা কার্যক্রম:

ডুয়েটে শুধুমাত্র ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীরাই বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রামে ভর্তির সুযোগ পায়। এখানে মূলত প্রকৌশলের বিভিন্ন শাখায় স্নাতক (Undergraduate) এবং স্নাতকোত্তর (Postgraduate) পর্যায়ে শিক্ষা প্রদান করা হয়।

ডুয়েটের অনুষদ এবং বিভাগসমূহ:

ডুয়েটে প্রধানত তিনটি অনুষদ রয়েছে:

  • পুরকৌশল অনুষদ (Faculty of Civil Engineering): এই অনুষদের অধীনে পুরকৌশল (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং) বিভাগ রয়েছে।
  • তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল অনুষদ (Faculty of Electrical and Electronic Engineering): এই অনুষদের অধীনে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল (ইইই) এবং ইলেকট্রনিক্স ও যোগাযোগ কৌশল (ইসিই) বিভাগ রয়েছে।
  • যন্ত্রকৌশল অনুষদ (Faculty of Mechanical Engineering): এই অনুষদের অধীনে যন্ত্রকৌশল (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং), শিল্প ও উৎপাদন কৌশল (আইপিই), টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেটেরিয়ালস এন্ড মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ রয়েছে।

এছাড়াও, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই), গণিত, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান এবং মানবিক বিভাগও এখানে বিদ্যমান।

ভর্তি প্রক্রিয়া:

ডুয়েটে ভর্তি প্রক্রিয়া অন্যান্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছুটা ভিন্ন। এখানে শুধুমাত্র পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরাই ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। ভর্তি পরীক্ষা সাধারণত MCQ পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয়। ডিপ্লোমা পরীক্ষার ফলাফল এবং ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে মেধাতালিকা তৈরি করা হয়। ভর্তি সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য ডুয়েটের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়।

শিক্ষক ও শিক্ষার্থী:

ডুয়েটে অভিজ্ঞ ও দক্ষ শিক্ষক মণ্ডলী রয়েছেন। এখানে দেশের বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে উত্তীর্ণ মেধাবী শিক্ষার্থীরা অধ্যয়ন করে।

গবেষণা:

ডুয়েট গবেষণা কার্যক্রমের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকল্পে অংশগ্রহণ করে।

সুযোগ-সুবিধা:

  • আধুনিক ল্যাবরেটরি এবং ওয়ার্কশপ
  • সমৃদ্ধ লাইব্রেরি
  • কম্পিউটার সেন্টার
  • আবাসিক হল
  • খেলার মাঠ ও জিমনেশিয়াম
  • মেডিকেল সেন্টার
  • ক্যাফেটেরিয়া ও ক্যান্টিন

যোগাযোগ:

ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট) গাজীপুর-১৭০০, বাংলাদেশ ওয়েবসাইট: www.duet.ac.bd

কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্য:

  • ডুয়েট বাংলাদেশের একমাত্র প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় যা বিশেষভাবে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের উচ্চশিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত।
  • এখানকার গ্র্যাজুয়েটরা দেশ ও বিদেশে বিভিন্ন শিল্প ও প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত আছেন।

ভর্তিচ্ছুদের জন্য কিছু পরামর্শ:

  • ডুয়েটে ভর্তি হতে চাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষায় ভালো ফল করার পাশাপাশি ভর্তি পরীক্ষার জন্য ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে।
  • ডুয়েটের ওয়েবসাইটে ভর্তি সংক্রান্ত সকল তথ্য, যেমন - ভর্তি পরীক্ষার নিয়ম, সিলেবাস, আসন সংখ্যা, পরীক্ষার তারিখ ইত্যাদি পাওয়া যায়।
  • প্রকৌশল বিষয়ে আগ্রহ এবং কঠোর পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকলে ডুয়েট আপনার জন্য একটি ভালো পছন্দ হতে পারে।

ডুয়েটের বিভাগসমূহ (আরও বিস্তারিত):

ডুয়েটে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি সম্পর্কিত বিভিন্ন বিভাগ রয়েছে। প্রতিটি বিভাগই স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল এবং দেশের শিল্প ও প্রযুক্তিখাতে দক্ষ জনবল তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিভাগ হলো:

  • পুরকৌশল (Civil Engineering - CE): এই বিভাগে অবকাঠামো নির্মাণ, যেমন - রাস্তা, সেতু, বাঁধ, ভবন, পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা, পরিবেশ প্রকৌশল, জিওটেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি বিষয় পড়ানো হয়।
  • তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল (Electrical and Electronic Engineering - EEE): এই বিভাগে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ, ইলেকট্রনিক সার্কিট ডিজাইন, মাইক্রোপ্রসেসর, কমিউনিকেশন সিস্টেম, কন্ট্রোল সিস্টেম, পাওয়ার ইলেকট্রনিক্স, ইলেকট্রিক্যাল মেশিন ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত।
  • যন্ত্রকৌশল (Mechanical Engineering - ME): এই বিভাগে মেশিন ডিজাইন, ম্যানুফ্যাকচারিং প্রসেস, থার্মোডায়নামিক্স, ফ্লুইড মেকানিক্স, অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, পাওয়ার প্ল্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারিং, রেফ্রিজারেশন ও এয়ার কন্ডিশনিং, মেকাট্রনিক্স ইত্যাদি বিষয় পড়ানো হয়।
  • কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল (Computer Science and Engineering - CSE): এই বিভাগে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, অ্যালগরিদম, ডেটা স্ট্রাকচার, ডেটাবেজ, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, সাইবার সিকিউরিটি, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত।
  • ইলেকট্রনিক্স ও যোগাযোগ কৌশল (Electronics and Communication Engineering - ECE): এই বিভাগে টেলিযোগাযোগ সিস্টেম, অপটিক্যাল ফাইবার কমিউনিকেশন, মাইক্রোওয়েভ ইঞ্জিনিয়ারিং, স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন, মোবাইল কমিউনিকেশন, রাডার সিস্টেম, এমবেডেড সিস্টেম ইত্যাদি বিষয় পড়ানো হয়।
  • শিল্প ও উৎপাদন কৌশল (Industrial and Production Engineering - IPE): এই বিভাগে উৎপাদন পরিকল্পনা, মান নিয়ন্ত্রণ, অপারেশন রিসার্চ, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অটোমেশন, প্রোডাকশন প্ল্যানিং এন্ড কন্ট্রোল, ওয়ার্ক স্টাডি ইত্যাদি বিষয় পড়ানো হয়।
  • টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং (Textile Engineering - TE): এই বিভাগে টেক্সটাইল ফাইবার, ইয়ার্ন, ফেব্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং, টেক্সটাইল টেস্টিং, টেক্সটাইল কেমিস্ট্রি, গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারিং, টেক্সটাইল ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি বিষয় পড়ানো হয়।
  • মেটেরিয়ালস এন্ড মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং (Materials and Metallurgical Engineering - MME): এই বিভাগে বিভিন্ন ধাতব ও অধাতব পদার্থ, তাদের বৈশিষ্ট্য, উৎপাদন প্রক্রিয়া, ব্যবহার, এবং মেটালার্জিক্যাল প্রসেস নিয়ে পড়ানো হয়।
  • গণিত (Mathematics): এই বিভাগে প্রকৌশলের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত গাণিতিক পদ্ধতি ও তত্ত্ব পড়ানো হয়।
  • পদার্থবিজ্ঞান (Physics): এই বিভাগে প্রকৌশলের মৌলিক বিষয়গুলির সাথে সম্পর্কিত পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারণা ও তত্ত্ব পড়ানো হয়।
  • রসায়ন (Chemistry): এই বিভাগে প্রকৌশলের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত রাসায়নিক প্রক্রিয়া ও পদার্থের বৈশিষ্ট্য পড়ানো হয়।

ডুয়েটের সুযোগ-সুবিধা (আরও কিছু):

  • গবেষণা ও প্রকাশনা: ডুয়েট শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গবেষণা কার্যক্রমকে উৎসাহিত করে এবং তাদের গবেষণাপত্র বিভিন্ন জার্নাল ও কনফারেন্সে প্রকাশিত হয়।
  • ক্লাব ও সোসাইটি: শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমের জন্য বিভিন্ন ক্লাব ও সোসাইটি রয়েছে, যেমন - রোবোটিক্স ক্লাব, ডিবেটিং ক্লাব, ফটোগ্রাফি ক্লাব, স্পোর্টস ক্লাব, ডুয়েট ক্যারিয়ার ক্লাব ইত্যাদি।
  • ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং ও ইন্টার্নশিপ: ডুয়েট শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং ও ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা করে, যা তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনে সহায়ক।
  • সেমিনার ও ওয়ার্কশপ: বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিভাগ কর্তৃক সেমিনার, ওয়ার্কশপ ও কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়, যা শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বৃদ্ধিতে সহায়ক।
  • ক্যাফেটেরিয়া ও ক্যান্টিন: ক্যাম্পাসের ভিতরে শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যাফেটেরিয়া ও ক্যান্টিনের ব্যবস্থা রয়েছে।
  • চিকিৎসা কেন্দ্র: শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য ক্যাম্পাসে একটি চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে।
  • পরিবহন ব্যবস্থা: গাজীপুর শহর এবং ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে ডুয়েট ক্যাম্পাসে যাতায়াতের জন্য পরিবহন ব্যবস্থা রয়েছে।

ডুয়েটের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা:

ডুয়েট ভবিষ্যতে আরও নতুন বিভাগ খোলা, গবেষণার মান আরও উন্নত করা, ইন্ডাস্ট্রির সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা এবং আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।

ভর্তিচ্ছুদের জন্য কিছু টিপস:

  • ডুয়েটে ভর্তি হতে চাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষায় ভালো ফল করার পাশাপাশি ভর্তি পরীক্ষার জন্য ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। বিগত বছরের প্রশ্নপত্র সমাধান করা এবং নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে ভালো ফল করা সম্ভব।
  • ডুয়েটের ওয়েবসাইটে ভর্তি সংক্রান্ত সকল তথ্য, যেমন - ভর্তি পরীক্ষার নিয়ম, সিলেবাস, আসন সংখ্যা, পরীক্ষার তারিখ, ফলাফল ইত্যাদি পাওয়া যায়। নিয়মিত ওয়েবসাইট ভিজিট করুন।
  • প্রকৌশল বিষয়ে প্রবল আগ্রহ এবং কঠোর পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকলে ডুয়েট আপনার জন্য একটি চমৎকার পছন্দ হতে পারে।

নবীনতর পূর্বতন